বাদ্যযন্ত্র ও ইজমা
মিউজিক জায়েয করার মত মোটেই ইজমার খেলাফ শায মত নয়। এটা বহুল প্রচলিত ভ্রান্তিগুলোর একটি। এ ধরণের ভ্রান্তপূর্ণ ইজমার দাবি করার ব্যাপারে ইমাম আহমদ সতর্ক করে বলেছেন,
من ادعى الإجماع فهو كاذب لعل الناس اختلفوا، هذه دعوى بشر المريسي والأصم، ولكن يقول: "لا نعلم الناس اختلفوا" إذا هو لم يبلغه.
"যে ব্যক্তি ইজমার দাবি করে সে একজন মিথ্যুক। হয়ত আলেমদের ইখতিলাফ আছে। এই জাতীয় ইজমার দাবি বিশরে মুরাইসি ও আসাম এর মত (বিভ্রান্ত) লোকেরাই কেবল করে। বরং বলা উচিত যে, আমি এই বিষয়ে মতভেদ জানি না। কারণ হয়ত তার কাছে ভিন্নমতের খবর পৌঁছায় নি।"
একই কথা ইমাম শাফেয়ী থেকেও বর্ণিত।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম আহমদ ও শাফেয়ীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন,
"وليس مراده بهذا استبعاد وجود الإجماع، ولكن أحمد وأئمة الحديث بُلُوا بمن كان يرد عليهم السنة الصحيحة بإجماع الناس على خلافها، فبين الشافعي وأحمد أن هذه الدعوى كذب، وأنه لا يجوز رد السنن بمثلها
"ইমাম আহমদ এই কথা বলে ইজমা সংঘটিত হওয়া অসম্ভব এমন বোঝান নি। মূলত আহমদ ও হাদীসের ইমামগণ এমন কিছু লোকের পাল্লায় পড়েন যারা ইজমার দাবি করে বিশুদ্ধ সুন্নতকে প্রত্যাখ্যান করত এই বলে যে এই মতটি ইজমার বিপরীত। এ কারণে ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ বলতেন যে, তোমাদের দাবি মিথ্যা। এই জাতীয় ভিত্তিহীন দাবি করে সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত বিষয় প্রত্যাখ্যান করা যাবে না।"
মালিকি মাজহাবের বিখ্যাত আত তাজ ওয়াল ইকলিল কিতাবে ঐতিহ্যবাহী গ্রানাডার ইমাম মুহাম্মদ বিন আল আব্দারি আল মালিকি বলেন :
وقال ابن عرفة : عن عز الدين بن عبد السلام : إنه متفق على علمه ودينه لا ينعقد إجماع بدونه .
"ইমাম ইবন আরাফা বলেন :
ইজ্জুদ্দিন বিন আব্দুস সালাম এমন এক মনীষী যার জ্ঞান, ধার্মিকতা সর্বজনস্বীকৃত। তিনি এমন এক ব্যাক্তি যার মতকে অগ্রাহ্য করে কোনদিন ইজমা হতে পারে না।"
সুলতানুল ওলামা ইজ্জুদ্দিন বিন আব্দুস সালাম তার বিখ্যাত "কাওয়ায়েদ" গ্রন্থে বলেন :
الطريق في صلاح القلوب يكون بأسباب من خارج فيكون بالقرآن وهؤلاء أفضل أهل السماع ، ويكون بالوعظ والتذكير ويكون بالحداء والنشيد ويكون بالغناء بالآلات المختلف في سماعها كالشبابات ، فإن كان السامع لهذه الآلات مستحلا سماع ذلك فهو محسن بسماع ما يحصل له من الأحوال وتارك للورع لسماعه ما اختلف في جواز سماعه ، وإلا فهو محسن بما حصل له من الأحوال مسيء في سماع ما هو يعتقد تحريمه .
"অন্তরের সংশোধনের জন্য বাহ্যিক কিছু মাধ্যম প্রয়োজন। এটা হতে পারে কোরআন। শ্রোতাদের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ।
এটা হতে পারে ওয়ায ও আলোচনার মাধ্যমে। হতে পারে এটা ছন্দ ও কাব্যের মাধ্যমে।
বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গান গেয়েও এটা হতে পারে যার কিছু নিয়ে আলেমদের মতভেদ আছে, যেমন - বাঁশী।
যদি এই বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারকে জায়েয মনে করে এবং এর চর্চা করে তবে তার বিষয়টি উত্তম কেননা সে নিজের মাঝে কাঙ্ক্ষিত মানসিক অবস্থা নিয়ে আসতে পারছে।
কিন্তু এমন বিষয় শোনার কারণে যা নিয়ে আলেমদের ইখতেলাফ আছে সে সতর্কতা ও পরহেজগারিতার ত্যাগ করেছে।"
আবুল মাওয়াহেব শাযেলী তার 'ফারহুল আসমা বিরুখাসিস সিমা' গ্রন্থে বলেন,
وقال الشيخ ابن القماح: "سئل الشيخ عز الدين بن عبد السلام عن الآلات كلها، فقال: مباح، فقال الشيخ شرف الدين التلمساني: يريد أنه لم يرد دليل صحيح من السنة على تحريمه، يخاطب بذلك أهل مصر، فسمعه الشيخ عز الدين فقال: لا، أردت أن ذلك مباح".
"শায়খ ইবনুল কাম্মাহ বলেন, 'শায়খ ইযযুদ্দিন বিন আব্দিস সালামকে সকল বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তিনি উত্তর দেন, 'জায়েয।'
এতে শরফুদ্দিন তিলমিসানি মিসরের লোকদের বলেন, তিনি মূলত বোঝাতে চাচ্ছেন যে বাদ্যযন্ত্রের হারাম-জ্ঞাপক কোন বিশুদ্ধ দলিল নবির সুন্নত থেকে বর্ণিত নেই।
শায়খ ইযযুদ্দিনের কাছে এই কথা পৌঁছালে তিনি বলেন, 'না। আমি বুঝিয়েছি যে, বাদ্যযন্ত্র বৈধ।'"
আত তাজ ওয়াল ইকলিল কিতাবে আরো বলা হয়েছে :
وعرف عياض بالشبلي فقال : هو شيخ الصوفية ذو الأنباء البديعة وواحد المتصوفين في علوم الشريعة عالما فقيها على مذهب مالك .
"শিবলীর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে কাজী ইয়াজ বলেছেন যে, তিনি সুফিকুলের শায়খ। কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব। ইমাম মালেকের মাযহাবে পারদর্শী ফকিহ ও তাসাউফ চর্চাকারী।
قال : سئل عن السماع فقال : ظاهره فتنة وباطنه عبرة فمن عرف الإشارة حل له استماع العبرة .
"শিবলীকে সঙ্গীত চর্চা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন :
বাহ্যিক দিক থেকে সঙ্গীত ফিৎনা, কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক থেকে সঙ্গীত অনুপ্রেরণা। সুতরাং যে সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানে, তার জন্য অনুপ্রেরণা গ্রহণ করতে সঙ্গীত শোনা বৈধ।"
বাদ্যযন্ত্র হারাম হবার বিষয়ে ইজমার যে দাবি করা হয় সেটা ভিত্তিহীন। আল্লামা শাওকানি এই ভ্রান্তি দূর করতে স্বতন্ত্র বই রচনা করেছেন। আমরা মিউজিক হারাম হবার পক্ষে থাকা এমন দুইজন ইমামের নাম বক্তব্য উল্লেখ করছি যারা ইলমি সততার জায়গা থেকে তারা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বাদ্যযন্ত্রের মাসআলায় কোন ইজমা নেই। তার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অনেক আলেমই মতপার্থক্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল না হবার কারণে ইজমার দাবি তুলেছেন। কিন্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই দাবি ভিত্তিহীন। ইজমা হাকার ব্যাপারে আলেমদের মাঝে এই ধরণের ত্রুটিবিচ্যুতি খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই সমস্যার কথা ক্লাসিকাল টেক্সটে অভিজ্ঞ সবাই জানেন। আমরা সালাফি আলেম শায়খ ইবনে উসায়মিনের এই বিষয়ে একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেন,
"وما أكثر ما نسمع من ينقل الإجماع .. عند التأمل لا يكون اجماعًا. ومن أغرب ما نُقل في الإجماع أن بعضهم قال: أجمعوا على قبول شهادة العبد. وآخرون قالوا: أجمعوا على أنها لا تُقبل .. هذا من غرائب النقل؛ لأن بعض الناس إذا كان من حوله اتفقوا على رأي، ظن أن لا مخالف لهم"
অধিকাংশক্ষেত্রে
ইজমার যে সকল বর্ণনা আমরা শুনে থাকি গবেষণার পর দেখা যায় যে সেগুলোতে কোন ইজমা নেই।
ইজমা দাবি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অদ্ভুত আমি যা দেখেছি, তা হল - কেউ কেউ দাবি করেছে
দাসের সাক্ষ্য কবুল হবে কারণ এই বিষয়ে ইজমা আছে। ওদিকে অন্যরা দাবি করেছে, না, কবুল
হবে না, কারণ ইজমা আছে। এটা খুবই অদ্ভুত এক উদাহরণ। মূলত কিছু মানুষ আছে তারা যখন দেখে
যে, তাদের আশেপাশের সবাই সহমত আছে, তারা ভেবে বসে যে এই বিষয়ে হয়ত কোন ভিন্নমতের কেউ
নাই!
বাদ্যযন্ত্রের বিষয়ে ইজমার দাবিও এমনই অদ্ভুত বিষয়।
ইবনে হাজার আসকালানি ফাতহুল বারীতে লিখেছেন,
"وأما الالات فسيأتى الكلام على اختلاف العلماء فيها عند الكلام على حديث المعازف في كتاب الأشربة وقد حكى قوم الإجماع على تحريمها وحكى بعضهم عكسه وسنذكر بيان شبهة الفريقين إن شاء الله تعالى
বাদ্যযন্ত্রের বিষয়ে আলেমদের মতভেদের কথা আমরা কিতাবুল আশরিবা-তে পরিচ্ছেদে মাআযিফের হাদিস প্রসঙ্গে আলোচনা করব। একদল বাদ্যযন্ত্র হারাম হবার ব্যাপারে ইজমা হেকেছে, আরেকদল এর বিপরীত মতের ব্যাপারে ইজমা হেকেছে। আমরা উভয় দলের (ইজমা দাবি করার ক্ষেত্রে) সংশয় ও ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। (সমাপ্ত)
একইভাবে ইবনে তায়মিয়্যাহ মাজমুউল ফাতাওয়া তে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন এই মতভেদের বিষয়টি।
وَاسْتِمَاعِ الْغِنَاءِ وَالْمَعَازِفِ وَنَحْوِ ذَلِكَ مِمَّا لِلنَّاسِ فِيهِ قَوْلَانِ التَّحْرِيمُ وَالْإِبَاحَةُ . فَإِنَّ جُمْهُورَ الْمُسْلِمِينَ عَلَى أَنَّهَا مُحَرَّمَةٌ وَبَعْضُهُمْ أَبَاحَهَا
গান
ও বাদ্য শোনা এমন একটি বিষয় যা নিয়ে মানুষের দুইটি মত আছে - হারাম ও বৈধতা। অধিকাংশ
মুসলিমের মতে এটি হারাম, তবে অনেকেই একে বৈধ বলেছে। (সমাপ্ত)
আল্লামা শাওকানি তার "ইবতালুদ দা'ওয়া" রিসালায় লিখেছেন,
وحكى أبو الفضل بن طاهر في مؤلفه في السماع أنه لا خلاف بين أهل المدينة في إباحة العود. قال ابن النحوي في العدة: قال ابن طاهر هو إجماع أهل المدينة، قال ابن طاهر: وإليه ذهبت الظاهرية قاطبة
আবুল ফাদল বিন তাহের তার "সিমা" নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মদীনাবাসীর মাঝে উদ বাজানোর বৈধতার ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। ইবনুন নাহবি "আল উদ্দাহ"তে বলেছেন, ইবনে তাহের একে (গানবাদ্যের বৈধতা) মদীনাবাসীর ইজমা বলেছেন। ইবনে তাহের বলেছেন, এছাড়াও সুনিশ্চিতভাবে এটি যাহেরি মাযহাবের অবস্থান।
أخْبَرَنا أبُو الفَتْحِ عَبْدُ الرّازِقِ بْنُ عَبْدِ الكَرِيمِ الصُّوفِيُّ بِأصْبَهانَ قالَ: أخْبَرَنا : أبُو الحَسَنِ عَلِيُّ ابْن إبْراهِيمَ بْنِ فِراسٍ إجازَةً قالَ: أخْبَرَنا أبُو سَعِيدٍ أحْمَدُ بْنُ مُحَمَّد ابْن زِيادِ بْنِ الأعْرابِيِّ قالَ: حَدَّثَنا القاسِمُ بْنُ نَصْرٍ. حَدَّثَنا إبْراهِيمُ بْنُ المُنْذِرِ، قالَ: حَدَّثَنا نافِعٌ حَدَّثَنِي مِكْتَلُ بْنُ أبِي سَهْلٍ عَن أبي بكر ابْن عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بن الحارِث ابْن هِشامٍ عَنْ زَيْدِ بْنِ ثابِتٍ قالَ: إذا رَأيْتَ أهْلَ المَدِينَةِ اجْتَمَعُوا عَلى شَيْءٍ فاعْلَمْ أنَّهُ سنة
আবুল ফাতহ আব্দুর রাযযাক বিন আব্দিল কারিম সুফি আমাদের ইসফাহান শহরে আবুল হাসান আলি বিন ইব্রাহিম বিন ফিরাস থেকে ইজাযতের ভিত্তিতে (মধ্যবর্তী রাবিদের নাম আরবি ইবারতে আছে) সাহাবি যায়দ বিন সাবেতের বক্তব্য বর্ণনা করেছেন, 'যদি তোমরা মদিনাবাসীদের কোন একটি কাজে একমত হতে দেখ, তবে জেনে নিও যে এটা নবির সুন্নাত।'
সুত্র : আস সিমা' লি ইবনিল কায়সারানি।
Comments
Post a Comment