নিচের লেখাটি আমার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর সাথে হয়েছিল, তাই “তুমি” সম্বোধন ব্যবহার করেছি।
প্রথমে আবু উমামার হাদীস নিয়ে কথা বলা যাক।
হাদীস ১: তুমি নিচের হাদিসটি উল্লেখ করেছ।
عَنْ أَبِيْ اُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لاَ تَبِيْعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوْهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوْهُنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ.
আবু ওমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় কর না, তাদের ক্রয় কর না, তাদের গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিয়ো না, তাদের উপার্জন হারাম’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৮০)।
উত্তর :
- এই হাদীস দয়ীফ জিদ্দান (অতি দূর্বল), এমন হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ দেয়া জায়েয নয়। মিশকাতে এই হাদীস উল্লেখ করে গ্রন্থকার বলেন:
رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَقَالَ التِّرْمِذِيُّ هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَعلي بن يزِيد الرواي يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ
“হাদীসটি আহমদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযি বলেছেন — এটি গরীর (একক সুত্রে বর্ণিত) হাদীস। আর বর্ণনাকারী আলী বিন ইয়াযীদ হাদীসে দূর্বল।”
চল, এবার তিরমিযীর কিতাবে যাই, দেখি তিনি কী বলেন -
قال أبو عيسى حديث أبي أمامة إنما نعرفه مثل هذا من هذا الوجه وقد تكلم بعض أهل العلم في علي بن يزيد وضعفه وهو شامي.
“আবু ঈসা (তিরমিযী) বলেন — আবু উমামার এই হাদীসটি আমরা একে কেবল এই একটি সুত্রে জানি। বেশ কিছু আহলে ইলম আলী বিন ইয়াযীদের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন এবং তাকে দয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন।”
তো আহলে ইলমরা এই আলী বিন ইয়াযীদের ব্যাপারে কী বলেছেন, ইমাম যাহাবীর মীযানুল এ’তেদাল থেকে দেখা যাক -
قَالَ الْبُخَارِيُّ مُنْكَرُ الْحَدِيثِ
وَقَالَ النَّسَائِيُّ لَيْسَ بِثِقَةٍ
وقَالَ أَبُو زُرْعَةَ لَيْسَ بِقَوِيٍّ
وقَالَ الدَّارَقُطْنِيُّ مَتْرُوكٌ
বুখারী বলেছেন — তার হাদীস মুনকার।
নাসায়ী বলেছেন — নির্ভর অযোগ্য।
আবু যুর’আহ বলেছেন — শক্তিশালী নয়।
দারাকুতনী বলেছেন — পরিত্যাজ্য।
তোমার মনে প্রশ্ন হতে পারে — এমন হাদীসকে কোন যুক্তিতে তোমার বইয়ে সহীহ হাদীস বলা হয়েছে? — আসলে এটা আলবানীর তাকলীদ করে করা। আলবানী সিলসিলায়ে সহীহাতে এই হাদীসটা উল্লেখ করে একে দূর্বল বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি একে অন্য এক হাদীসের সাহায্য নিয়ে দয়ীফ থেকে হাসান লি-গায়রিহি প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। এটা আলবানীর তাহকীক করার মানহাজে বড় ধরণের ত্রুটি। কারণ মাতরুক, মুনকার, গায়রে সিকাহ রাবীর হাদীসকে হাসান লি-গায়রিহি বানানো যায় না।
দেখো, ইবনে হাজার কী লিখেছেন -
ثم الطعن: إمَّا أنْ يَكُونَ:
1- لِكَذِبِ الرَّاوِي. 2- أَوْ تُهْمَتِهِ بِذلِكَ. 3- أوْ فُحْشِ غَلَطِهِ.
4- أَوْ غَفْلَتِهِ. 5- أَوْ فِسْقِهِ. 6- أَوْ وَهْمِهِ.
7- أَوْ مُخَالَفَتِه. 8- أَوْ جَهَالَتِه. 9- أَوْ بِدْعَتِهِ. 10- أو سُوءِ حِفْظِهِ.
فالأوَّلُ: الْمَوْضُوعُ، والثَّانِي: الْمَتْرُوكُ. والثَّالِثُ: المُنْكَرُ، عَلَى رَأْيٍ. وكَذَا الرَّابِعُ والخَامِسُ
অর্থাৎ রাবীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ১০টি স্তর আছে। সবচেয়ে মারাত্মক স্তর হল ১ নম্বর, সবচেয়ে কম মারাত্মক হল ১০ নম্বর।
১. যে রাবী মিথ্যা বলে তার হাদীসকে মাওদ্বু বলা হয়।
২. যার ব্যাপারে মিথ্যা বলার অভিযোগ থাকে, তাকে মাতরুক বলা হয়।
৩, ৪, ৫. যার বর্ণনায় মারাত্মক রকম ভূল থাকে, তার হাদীসকে মুনকার বলা হয়। একইভাবে সঠিকভাবে হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে গাফেল হলে কিংবা ফাসেক হলে, তার হাদীসকে মুনকার বলা হয়।
তোমার দেয়া হাদীস হচ্ছে — মাতরুক ও মুনকার রাবী আলী বিন ইয়াযীদের হাদীস। এমন লোকের হাদীসকে হাসান লি-গায়রিহি বানানো যায় না। কারণ হাসান লি-গায়রিহি বানানোর শর্ত হচ্ছে -
وَمَتَى تُوبِعَ سَيِّءُ الْحِفْظِ بِمُعْتَبَرٍ، وَكَذَا الْمَسْتُورُ، وَالْمُرْسَلُ، وَالْمُدَلَّسُ: صَارَ حَدِيثُهُمْ حَسَناً لا لِذَاتِهِ، بَلْ بالْمَجْمُوع.
অর্থাৎ দয়ীফ হাদীস হাসান লি-গায়রিহি হবে যদি দয়ীফ হাদীসের রাবী দূর্বল স্মৃতিবিশিষ্ট রাবী অথবা মাসতুর (এমন রাবী যার নাম বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় কিন্তু তিনি সিকাহ এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় না) অথবা মুদাল্লিস হয়। অর্থাৎ ৯ ও ১০ নং স্তরের রাবীর হাদীসকেই কেবল অন্য হাদীস দিয়ে হাসান লি-গায়রিহি বানানো যায়। এর উপরের স্তরে যারা আছে, তাদের হাদীস দিয়ে নয়।
আহমদ শাকের এটা খোলাসা করে ‘আল বা’য়েস আল হাসীস’ কিতাবের টীকায় লিখেন -
“ وبذلك يتبين خطأ كثير من العلماء المتأخرين في إطلاقهم أن الحديث الضعيف إذا جاء من طرق منعددة ضعيفة ارتقى إلى درجة الحسن أو الصحيح، فإنه إذا كان ضعف الحديث لفسق الراوي أو اتهامه بالكذب ، ثم جاء من طرق أخرى من هذا النوع ،ازداد ضعفا إلى ضعف ، لأن تفرد المتهمين بالكذب أو المجروحين في عدالتهم بحيث لا يرويه غيرهم يرفع الثقة بحديثهم ، ويؤيد ضعف روايتهم ، وهذا واضح .”
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرِ بْنِ سُفْيَانَ الرَّقِّيُّ، ثنا أَيُّوبُ بْنُ مُحَمَّدٍ الْوَزَّانُ، ح وحَدَّثَنَا عَبْدَانُ بْنُ أَحْمَدَ، ثنا الْعَبَّاسُ بْنُ الْوَلِيدِ الْخَلَّالُ الدِّمَشْقِيُّ، قَالَا: ثنا الْوَلِيدُ بْنُ الْوَلِيدِ، ثنا ابْنُ ثَوْبَانَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ الْحَارِثِ، عَنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ: «لَا يَحِلُّ بَيْعُ الْمُغَنِّيَاتِ وَلَا شِرَاؤُهُنَّ، وَلَا تِجَارَةٌ فِيهِنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ»
এই হাদীসে আছে — আল ওলীদ বিন আল ওলীদ এবং ইবনে সাওবান। এই দুইজনেই দূর্বল। অথচ আলবানী বলছেন -
قلت: وهذا إسناد حسن، الوليد بن الوليد هو
العنسي القلانسي الدمشقي، قال ابن أبي حاتم (4 / 2 / 19) عن أبيه: “ صدوق،
ما بحديثه بأس، حديثه صحيح “. ومن فوقه معروفون من رجال التهذيب على كلام في
بعضهم
তিনি আল ওলীদের পক্ষে কেবল ইবনে আবি হাতেমের তা’দীল উল্লেখ করছেন। ভালো কথা। কিন্তু এর উপরের রাবীদের ব্যাপারে? আলবানী বলছেন — “উপরের রাবীরা তাহযীব কিতাবের পরিচিত রাবী, তবে তাদের কারো কারো ব্যাপারে মন্তব্য আছে।” কী সেই মন্তব্য সেটা তিনি উল্লেখ করেন নি। চল আমরা সেটা ইবনে হাজার লিখিত তাহযীবুত তাহযীবে থেকে দেখে নেই -
قال الأثرم عن أحمد أحاديثه مناكير
আসরাম ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণনা করেন — তার হাদীসগুলো মুনকার।
وقال محمد بن الوراق عن أحمد لم يكن بالقوي في الحديث
মুহাম্মদ বিন ওয়াররাক ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন — সে হাদীসে শক্তিশালী নয়।
وقال الدوري عن ابن معين والعجلي وأبو زرعة الرازي لين وقال معاوية بن صالح عن ابن معين ضعيف
দাওরী বর্ণনা করেন ইবনে মাঈন, আল ‘আজলী, আবু যুর’আহ বলেছেন : সে নরম/সহজতকারী। মুয়াবিয়া বিন সালেহ বর্ণনা করেন : ইবনে মাঈন বলেছেন — সে দূর্বল।
وقال النسائي ضعيف وقال مرة ليس بالقوي وقال مرة ليس بثقة
নাসায়ী বলেন — সে দূর্বল, আরেকবার বলেছেন — সে শক্তিশালী নয়, আরেকবার বলেছেন — সে সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) নয়।
অর্থাৎ আলবানী তিরমিযির দয়ীফ হাদীসকে যেই হাদীসের ভিত্তিতে হাসান বলার চেষ্টা করেছেন সেটা নিজেও দূর্বল। একজন মুনকার, মাতরুক রাবীর হাদীস অন্য আরেক দূর্বল রাবীর বর্ণনা দিয়ে হাসান হয় না।
এবার আসা যাক আল ওলীদের প্রসঙ্গে। আলবানী তো তার পক্ষে ইবনে আবি হাতেমের পক্ষে তা’দীল উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অন্য ইমামরা কী বলেছেন? মুসনাদে আহমদের তাহকীকে তোমার দেয়া হাদীসের ইসনাদ আলোচনায় শু’আইব আরনাউত ও তার সহকর্মীরা লিখেছেন -
وأخرجه الطبراني في “الكبير” (7749) ، وفي “الشاميين” (321) و (893) من طريق الوليد بن الوليد -وهو العنسي الدمشقي- عن عبد الرحمن بن ثابت ابن ثوبان، عن يحيى بن الحارث الذماري، عن القاسم، به. قلنا: الوليد بن الوليد قال فيه الدارقطني: منكر الحديث.
তাবারানী এই হাদীস মুজামে কবীরে ও শামিয়্যিন কিতাবে এনেছেন আল ওলীদ বিন আল ওলীদের সুত্রে। এই আল ওলীদ বিন আল ওলীদ হলেন আল আনসী আদ দিমাশকি। তিনি বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমাত বিন সাবেত বিন সাওবান বিন হারেস আল যিমারী থেকে, তিনি আল কাসেম থেকে। আমরা বলি — এই আল ওলীদ বিন আল ওলীদের ব্যাপারে দারাকুতনী বলেছেন — “তার হাদীস মুনকার”।
এবার তুমিই বল এক মুনকার রাবীর হাদীসকে কীভাবে আরেক মুনকার রাবীর হাদীস দিয়ে আলবানী হাসান বানালেন? আর কীভাবে তোমার দেয়া বইয়ের লেখক আলবানীর হাসান লি গায়রিহি বলাকে সহীহ বানালেন? হয়ত তোমার দেয়া বইয়ের লেখক দেখছেন যে, এটা আলবানীর সিলসিলা সহীহাতে আছে। ব্যস, একে সহীহ বানিয়ে দিয়েছেন। খুবই সস্তা মানের লেখক হবে হয়ত।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই এই হাদীস গ্রহণযোগ্য তবুও এতে বাদ্যযন্ত্র হারাম প্রমাণ হয় না। বরং গায়িকা দাসী কেনা-বেচা নিষেধ বোঝা যায় কেবল। তুমি মেশকাত কিতাবের রেফারেন্স উল্লেখ করেছ।
মেশকাতের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন -
(ولَا تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ) : بِفَتْحِ الْقَافِ وَسُكُونِ التَّحْتِيَّةِ : فِي الصِّحَاحِ: الْقَيْنُ الْأَمَةُ مُغَنِّيَةً كَانَتْ أَوْ غَيْرَهَا (وَلَا تَشْتَرُوهُنَّ) قَالَ التُّورِبِشْتِيُّ: وَفِي الْحَدِيثِ يُرَادُ بِهَا الْمُغَنِّيَةُ، لِأَنَّهَا إِذَا لَمْ تَكُنْ مُغْنِيَةً فَلَا وَجْهَ لِلنَّهْيِ عَنْ بَيْعِهَا وَشِرَائِهَا (وَلَا تُعَلِّمُوهُنَّ) أَيِ الْغِنَاءَ فَإِنَّهَا رُقْيَةُ الزِّنَا (وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ) قِيلَ: لَا يَصِحُّ بَيْعُهُنَّ لِظَاهِرِ الْحَدِيثِ، وَقَالَ الْقَاضِي: النَّهْيُ مَقْصُورٌ عَلَى الْبَيْعِ وَالشِّرَاءِ لِأَجْلِ التَّغَنِّي، وَحُرْمَةُ ثَمَنِهَا دَلِيلٌ عَلَى فَسَادِ بَيْعِهَا، وَالْجُمْهُورُ صَحَّحُوا بَيْعَهَا، وَالْحَدِيثُ مَعَ مَا فِيهِ مِنَ الضَّعْفِ، لِلطَّعْنِ فِي رِوَايَتِهِ مُؤَوَّلٌ بِأَنَّ أَخْذَ الثَّمَنِ عَلَيْهِنَّ حَرَامٌ كَأَخْذِ ثَمَنِ الْعِنَبِ مِنَ النَّبَّاذِ ; لِأَنَّهُ إِعَانَةٌ وَتَوَصَّلٌ إِلَى حُصُولِ مُحَرَّمٍ، لَا لِأَنَّ الْبَيْعَ غَيْرُ صَحِيحٍ. اهـ.
“(তোমরা ‘কাইন’দের বিক্রি করো না) — ক্বাফ যবর, ইয়া সাকীন দিয়ে উচ্চারণ হবে। সিহাহ অভিধান অনুযায়ী — কাইন হচ্ছে দাসী, চাই সে গায়িকা হোক অথবা না হোক।
(তাদের খরিদ করো না) — তুরিবিশতি বলেন — এই হাদীসের উদ্দেশ্য হচ্ছে গায়িকা দাসী। কারণ দাসী যদি গায়িকা না হয়, তবে তার কেনা-বেচা নিষিদ্ধ হবার কোন যুক্তি নেই।
(তাদেরকে) গান (শিখিও না) — কেননা এটি যেনা-ব্যাভিচারের জন্য উস্কানী হবে।
(তাদের মূল্য গ্রহণ হারাম) — কেউ কেউ বলেন — হাদীসের বাহ্যিক অনুযায়ী তাদের বিক্রি করা শুদ্ধ হবে না। কিন্তু আল কাযি বলেছেন — এখানে কেনা-বেচা নিষেধ করা হয়েছে গান গাওয়ার কারণে। আর হাদীসে যেহেতু মূল্যকে হারাম বলা হয়েছে, এতে বোঝা যায় যে, বেচাবিক্রি শুদ্ধ হবে না। কিন্তু জুমহুর আলেম বলেছেন — বিক্রি শুদ্ধ হবে, এই হাদীস দূর্বল এবং এর রেওয়ায়াত প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু তারপরেও একে গ্রহণ করা যায়, তবে এভাবে তাবীল করে — তাদের মূল্যগ্রহণ করা সেই অর্থে হারাম যেই অর্থে নাবিয বানানোর জন্য আঙ্গুর বিক্রির মূল্য গ্রহণ হারাম। কেননা এখানে একটি জায়েয কাজকে হারামে সহযোগী হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে। বিক্রি শুদ্ধ না একারণে হারাম নয়।”
- মোল্লা আলী কারীর মেরকাত থেকে সমাপ্ত।
এখন প্রশ্ন জাগে, দাসীর গান শোনা কি শর্তহীনভাবে হারাম? নাকি মনিবের জন্য জায়েয এবং অন্য পুরুষের জন্য হারাম? হারাম হলে কেন হারাম?
প্রথম প্রশ্নে আসা যাক — দাসীর গান শোনা কি হারাম?
- তোমার সাথে আমার মতভেদ হচ্ছে বাজনা নিয়ে। গান নিয়ে নয়। কারণ গানকে তুমিও জায়েয বল। তাই এই হাদীস আমার বিরুদ্ধে যায় না এবং কিছু প্রমাণও হয় না।
এবার পরের প্রশ্ন দুইটি দেখা যাক।
আল্লামা মুনাভী “ফায়দ্বুল কাদীর” কিতাবে এর উত্তর দিয়েছেন -
প্রথমে তিনি জামে’উস সগীরের এই হাদীসটি উল্লেখ করেন -
لله أشد أذنا إلى الرَّجُلِ الحَسَنِ الصَّوْتِ بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ مِنْ صاحب القينة إلى قَيْنَتِهِ
“মনিব তার (গায়িকা) দাসীর গান যত মনোযোগ দিয়ে শোনে আল্লাহ তা’আলা সুমিষ্ট কণ্ঠে কুরআন পাঠকের কুরআন পাঠ তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে শোনেন।” [মুসতাদরাকে হাকেমে এই হাদীসকে ইমাম হাকেম সহীহ হাদীস বলেছেন]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মুনাভী বলেন -
وفيه حل سماع الغناء من قينته ونحوها لأن سماع الله لا يجوز أن يقاس على محرم وخرج بقينته فينة غيره فلا يحل سماعها بل يحرم إن خاف ترتب فتنة
“এই হাদীস থেকে বোঝা যায় — নিজ দাসীর কণ্ঠে গান শোনা হালাল। কারণ যদি এটা হারাম হত, তাহলে একটা হারাম কাজ শোনার সাথে আল্লাহ তায়ালার শোনাকে তুলনা করা হত না। আর হাদীসে নিজের দাসী বলা হয়েছে, এ থেকে বোঝা যায় অন্যের দাসীর কণ্ঠে গান শোনা হালাল হবে না, বরং ফিতনার আশংকা থাকলে হারাম হবে।” (সমাপ্ত)
আমি (শেখ সাদী) বলি — এই ফিতনার আশংকাকে মোল্লা আলী কারী যেনা-ব্যাভিচারের উস্কানী বলেছেন।
সুতরাং, এই হাদীসকে প্রথমত গ্রহণযোগ্য ধরার কোন সুযোগ নেই। মুনকার রাবীর হাদীস। আর যদি গ্রহণযোগ্য ধরিও তবু এটা বাদ্যযন্ত্রের বিপক্ষে যায় না, বরং অন্য পুরুষের দাসীর কন্ঠে গান শোনা হারাম বোঝা যায়। আবার এটাও যেনা ও ফেতনার আশংকার কারণে।
হাদীস ২ : তুমি আরো উল্লেখ করেছ -
عنْ أَبِيْ مَالِكِ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْحِرَ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ.
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ ‘অবশ্যই অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে যারা যেনা, রেশম, নেশাদার দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’ (বুখারী হা/৫৫৯০)।
উত্তর :
(ক) সনদের দিক থেকে আলোচনা —
১। হাদিসটি বুখারির “সহীহ” এর অন্তর্ভূক্ত নয়। ইমাম বুখারী তার কিতাবে বিভিন্ন পরিচ্ছেদের শুরুতে মু’আল্লাক হাদিস উল্লেখ করে থাকেন। মূল বর্ণনাকারীর ও ইমাম বুখারীর মাঝে যখন অবিচ্ছিন্ন সংযোগ না থাকে, তখন তাকে মুয়াল্লাক হাদীস বলা হয়। হাদিসটি বর্ণনা করার সময় ইমাম বুখারীর নিজের দিকে নিসবত করেন নি। অর্থাৎ তিনি বলেন নি “হাদ্দাসানা হিশাম …” (হিশাম আমাদের বলেছেন)। বরং তিনি নিজের সম্পৃক্তি বাদ দিয়ে বলেছেন “ক্বালা হিশাম …” (হিশাম বলেছেন)
২। সঙ্গীতকে যারা হারাম বলে তাদের বক্তব্য হচ্ছে সহীহুল বুখারীতে ইমাম বুখারী নিজের দিকে সম্পৃক্ত না করলেও তিনি অন্যান্য গ্রন্থে, যেমন — তারীখে কাবীরে তিনি নিজের দিকে নিসবত করে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। এর জবাবে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে — হাদীসটি ইমাম বুখারী তার সহীহ’তে পূর্ণাঙ্গ সনদে (মুসনাদ) হিসেবে উল্লেখ না করে মুয়াল্লাক হিসেবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল হাদীসের মাঝে বিদ্যামান ইল্লত বা ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করা। যার বৃত্তান্ত হচ্ছে –
(ক) হাদীসের সনদে আছে তাবেয়ির স্তরে আছেন আতিয়্যাহ বিন কায়েস। তাহরিরু তাকরিবিত তাহযিব গ্রন্থে শুয়াইব আরনাউত ও বাশশার আওয়াদ বলছেন, صدوق حسن الحديث ولم يؤثر توثيقه عن كبير أحد من الأئمة وروى عنه جمع وذكره إبن حبان في الثقات
“সত্যবাদী। তার হাদীস হাসান। তবে বড় কোন ইমাম থেকে তার নির্ভরযোগ্যতার (সিকাত) ব্যাপারে কিছু বর্ণিত হয় নি। তবে অনেকেই তার সুত্রে বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান তাকে সিকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।” কিন্তু ইবনে হিব্বান তার সিকাত গ্রন্থে অনেক সহজতার পরিচয় দেন, এমনকি অজ্ঞাত অবস্থার বহু রাবীকে উল্লেখ করে থাকেন এটা মুহাদ্দিসদের মাঝে প্রসিদ্ধ বিষয়। আলবানী, মুয়াল্লিমী, মুকবিল বিন হাদী প্রত্যেকেই এই কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যগুলো নিচে দেয়া হল।
قال الالباني رحمه الله (سلسلة الأحاديث الصحيحة) (2/ رقم 633/ ص218–219):
(العجلي معروف بالتساهل في التوثيق ، كابن حبان تماماً ، فتوثيقه مردود إذا خالف أقوال الأئمة الموثوق بنقدهم وجرحهم)
قال العلامة عبدالرحمن المعلمي رحمه الله في (التنكيل)(1/66)
( و العجلي قريب منه- أي ابن حبان- في توثيق المجاهيل من القدماء).
وقال الشيخ مقبل بن هادي الوادعي رحمه الله في كتابه (المقترح في أجوبة بعض أسئلة المصطلح)( رقم 32/37–38)
(الذي يوثقه أحدهما أو كلاهما — ابن حبان والعجلي — فقد لا يكون بمنزلة صدوق، ويصلحُ في الشواهد والمتابعات، وإن كان العجلي يعتبر أرفعُ في هذا الشأن، فهما متقاربان).إنتهى
ইবনে হিব্বান ছাড়াও আবু হাতেম ও বাযযার আলোচ্য রাবীর ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেছেন। আবু হাতেম বলেছেন صالح الحديث (সালেহুল হাদিস) তার হাদিস চলে, বাযযার বলেছেন لا بأس به (লা বা`সা বিহি) তার সমস্যা নেই। হাদীস শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, এই দুইটি বিশেষণ বোঝায় যে, রাবী হিসেবে আতিয়্যাহ বিন কায়েস নিম্নপর্যায়ের। একজন রাবী নির্ভরযোগ্য হবার জন্য তার মাঝে দুটো জিনিস খোঁজা হয় — আদালত (ন্যায়পরায়ণতা) এবং দ্ববত (স্মৃতি ও সংরক্ষণ)। যেসব রাবীদের আদালতে সমস্যা না থাকে, কিন্তু দ্ববতে সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রেই উপরে উল্লিখিত বিশেষণ দুটো ব্যবহার করা হয়।
ইবনে আবি হাতেম তার “আল জারহু ওয়াত তা’দীল” গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ২৭তম পৃষ্ঠায় বলেছেন,
ذكر ابن ابي حاتم في مقدمة الجزء الأول من “ الجرح و التعديل “ « ص 27 » ما نصه
«و وجدت الألفاظ في الجرح و التعديل على مراتب شتى ، فإذا قيل للواحد :
إنه ثقة ، أو متقن ، أو ثبت ، فهو ممن يحتج بحديثه،
و إذا قيل : إنه صدوق ، أو محله الصدق ، أو لا بأس به، فهو ممن يكتب حديثه، وينظر فيه، و هي المنزلة الثانية
و إذا قيل : شيخ فهو بالمنزلة الثالثة ، يكتب حديثه و ينظر فيه ، إلاأنه دون الثانية،
وإذا قيل : صالح الحديث ، فإنه يكتب حديثه للاعتبار
“আমি লক্ষ্য করেছি জারহ ও তাদীলের (বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা বিচারের) ক্ষেত্রে অনেকগুলো স্তর রয়েছে।
যখন কারো ব্যাপারে বলা হয় তিনি সিকাহ (নির্ভরশীল) কিংবা মুতকিন (পারঙ্গম) কিংবা সাবাত (প্রামাণ্য), তখন তার বর্ণিত হাদিস প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তবে যদি কারো ব্যাপারে বলা হয় — সদুক (সত্যবাদী) কিংবা মাহাল্লুহুস সিদক (সত্যে অবস্থিত) কিংবা লা বা`সা বিহি (তার সমস্যা নেই), তবে তার বর্ণিত হাদিসগুলো লেখা হয় এবং দেখা হয়। তবে এটি দ্বিতীয় স্তরের।
অন্যদিকে যদি শায়খ বলা হয়, তবে এটি তৃতীয় স্তরের। তার হাদিস লেখা ও দেখা হয়। তবে এটি দ্বিতীয় স্তরের নিচে।
আর যদি বলা হয় সালেহুল হাদীস (তার হাদিস চলে), তবে তার হাদিস ইতেবার হিসেবে লেখা হয়। (উসুলে হাদিসের পরিভাষা অনুযায়ী ইতেবার অর্থ কোন একটি হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা বিচারের জন্য যখন সাক্ষ্য হিসেবে অন্যান্য হাদিস খোঁজা হয়)”
তাহলে দেখা যাচ্ছে জারহ তাদিলের কোন ইমামই আতিয়্যাহ বিন কায়েসের বর্ণিত হাদীসকে প্রামাণ্য বলেন নি, আবু হাতেম বলেছেন সালেহুল হাদীস অর্থাৎ চতুর্থ শ্রেণীর রাবী, বাযযার বলেছেন লা বা`সা বিহি অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর রাবী। মুহাদ্দিসদের মাঝে সুবিদিত আছে যে, আবু হাতেম রাবীদের ক্ষেত্রে কঠোরতা করতেন আর বাযযার করতেন সহজতা। সুতরাং আতিয়্যাহ বিন কায়েস দ্বিতীয় ও চতুর্থের মাঝামাঝি হওয়াই যৌক্তিক। তবে ইবনে হাজার তাকরিব গ্রন্থে তাকে সিকাহ বলেছেন এবং এটা ইবনে হাজারের ভুল ছিল। কারণ তিনি ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আতিয়্যাহ বিন কায়েসের ব্যাপারে আবু হাতেমের বক্তব্যের উপর নির্ভর করেছেন। আর আবু হাতেম তাকে শক্তিশালী সাব্যস্ত করেছেন। অথচ আবু হাতেমের বক্তব্য সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি যে, তার মতে আতিয়্যাহ বিন কায়েস চতুর্থ শ্রেণীর রাবী।
(খ) উপরোক্ত আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কেউ বলতে পারেন যে, আতিয়্যাহ বিন কায়েসকে তো কেউ যইফ বলেন নি। তার হাদিস সহিহ না হলেও অন্তত হাসান পর্যায়ের তো হবে। আর হাসান হাদিস তো গ্রহণযোগ্য! এর উত্তর হচ্ছে, উপরের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল রাবী হিসেবে আতিয়্যাহ বিন কায়েসের দ্ববত (স্মৃতি ও সংরক্ষণ) নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এই হাদীসটি নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে ধরা পরে যে, এই হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আতিয়্যাহ বিন কায়েস ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। কীভাবে? হাদিসটি তিনি ঠিক কোন সাহাবির কাছ থেকে শুনেছেন সেটা মনে রাখতে পারেন নি। তিনি সন্দেহ করেছেন যে, তিনি এটি আবু আমের আশআরীর কাছ থেকে শুনেছেন নাকি আবু মালেক আশআরীর কাছ থেকে। এছাড়াও এই হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ নিয়েও তার বর্ণনায় অসংলগ্নতা আছে। কোন কোন বর্ণনায় حر (হির) শব্দটি এসেছে, কোন কোন বর্ণনায় এসেছে নুক্তাযুক্ত অবস্থায় خز (খায), যেমন আবু দাউদে। ইমাম আবু দাউদ এই হাদিসটি উল্লেখ করার পর বলেছেন যে, প্রায় ত্রিশের মত সাহাবি খায (এক ধরণের পোশাক) পরিধান করেছেন। অর্থাৎ হাদিসটি যে উল্লতযুক্ত তিনি তা স্পষ্ট করেছেন।
(গ) ইমাম বুখারী এই হাদিসটি তারীখে কাবীরে বলেছেন হাদীসটি আবু আমের নয়, আবু মালেক আশআরী থেকেই প্রসিদ্ধ। আমরা যদি আতিয়্যাহ বিন কায়েস বাদ দিয়ে এই হাদিসটির অন্যান্য সুত্র সন্ধান করি তবে মালেক বিন আবি মারইয়ামের বর্ণনা খুঁজে পাই, যা সুনানে আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহতে উল্লিখিত আছে। ইবনে মাজাহতে আছে –
عَنْ مَالِكِ بْنِ أَبِي مَرْيَمَ قَالَ: «دَخَلَ عَلَيْنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ غَنْمٍ، فَتَذَاكَرْنَا الطِّلَاءَ فَقَالَ: حَدَّثَنِي أَبُو مَالِكٍ الْأَشْعَرِيُّ : أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَيَشْرَبَنَّ نَاسٌ مِنْ أُمَّتِي الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا يُعزَف على رؤوسهم بالمعازف والمغنيات، يخسف الله بهم الأرض، ويجعل منهم القردة والخنازير”. »
মালেক বিন আবি মারইয়াম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আব্দুর রহমান বিন গানাম আমাদের কাছে আসেন এবং তিলা-র (নেশাদ্রব্য) কথা উল্লেখ করে বলেন, আবু মালেক আশআরী আমাকে বলেছেন, তিনি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, “আমার উম্মতের এক কিছু লোক মদ খাবে এবং একে ভিন্ন নামে ডাকবে। তাদের মাথার উপরে বাদ্য বাজবে ও গায়িকারা থাকবে। তাদের যমিনে ধসিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের কাউকে বানর ও শুকড় বানিয়ে দেয়া হবে।”
বুখারীতে বর্ণিত আতিয়্যাহ বিন কায়েসের বর্ণিত হাদিসের সাথে মালেক বিন আবি মারইয়ামের বর্ণিত এই হাদীসের স্পষ্ট পার্থক্য আছে। এই হাদীসে বলা নেই যে, গানবাদ্যকে হালাল করা হবে। বরং মদের নাম পাল্টে দিয়ে সেটা পান করার ব্যাপারে হাদিসের এই শাস্তির কথা আছে। তাছাড়া ইমাম বুখারী নিজে যখন আতিয়্যাহ বিন কায়েসের মুয়াল্লাক হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তখন তিনি শিরোনাম দিয়েছেন بَابُ مَا جَاءَ فِيمَنْ يَسْتَحِلُّ الْخَمْرَ وَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ “মদকে যারা হালাল করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে” গানবাদ্য হারাম করার শিরোনামে সহীহ বুখারীতে কোন হাদিস ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন নি। এছাড়াও ইমাম বুখারীর উল্লিখিত ত্রুটিযুক্ত হাদিসটি যে স্বয়ং প্রামাণ্য নয়, বরং এই হাদিসটি তিনি মদ হালাল করা সংক্রান্ত হাদিসের পক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন এটা ইমাম মিযযি তার তাহযিবুল কামালে আতিয়্যাহ বিন কায়েসের আলোচনায় বলেছেন استشهد له البخاري بحديث واحد “বুখারী ইসতেশহাদ বা সাক্ষ্য হিসেবে তার একটি হাদিস ব্যবহার করেছেন” ইসতেশহাদ ও ইহতেজাজ এই দুইয়ের মাঝে তফাত হল, প্রথম ক্ষেত্রে হাদীসটি নিজে প্রমাণ হয় না, তবে অন্য কোন হাদিসের পক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হয়। অন্যদিকে ইহতেজাজ হল যখন খোদ হাদীসটি নিজেই প্রামাণ্য হয়।
২. সনদের দিক থেকে হাদিসটি যে ত্রুটিযুক্ত এটা প্রমাণ হবার পর আসা যাক, হাদিসের মতন নিয়ে আলোচনায়।
(ক) এই হাদীসে ইস্তেহলাল শব্দ থেকে মা’আযিফ (music) হারাম প্রমাণ হয় না। কারণ ইস্তেহলালের একাধিক অর্থ আছে। কখনো হালালকে হালাল হিসেবে গণ্য করা অর্থও হয়। উদাহরণ ইবনে হিব্বানের সহীহ হাদীস -
يوشك أحدكم أن يكذبني وهو متكئ على أريكته يحدث بحديثي، فيقول: بيننا وبينكم كتاب الله، فما وجدنا فيه من حلال استحللناه، وما وجدنا فيه من حرام حرمناه
“এমন এক সময় আসবে যখন আসনে হেলান দিয়ে কিছু লোক আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। তাকে যখন আমার হাদীস বলা হবে, সে বলবে — আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব আছে। এটাই যথেষ্ট। এতে আমরা যাকে হালাল পেয়েছি তাকে “ইস্তেহলাল” (হালাল গণ্য) করব। আর যাকে হারাম পেয়েছি, তাকে হারাম গণ্য করব।”
(খ) কেউ বলতে পারে এই হাদীসে তো মদের কথা আছে। তাহলে মদ যেহেতু হারাম, আর মদকে যেহেতু তারা হালাল গণ্য করছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, মদের বিধানই মদের সাথে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। উসুলে ফিকহের ভাষায় বলা হয় — দালালাতুল ইকতিরান। অর্থাৎ পাশাপাশি থাকার দলীল। এখন এই হাদীসের শব্দগুলোতে কি দালালাতুল ইকতিরান প্রযোজ্য? প্রযোজ্য হলেও কতটুকু প্রযোজ্য?
এর উত্তর পেতে আমরা হাদীসের শব্দগুলো দেখব।
- প্রথম শব্দ ছিল (হির)। এর অর্থ হচ্ছে যৌনাঙ্গ। তোমার অনুবাদক একে যেনা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু এটা আক্ষরিক/আভিধানিক অর্থ নয়। এখন যৌনাঙ্গ নিয়ে আলাপ করা যাক। হাদীসে বলা হচ্ছে — আমার উম্মতের একদল যৌনাঙ্গকে হালাল গণ্য করবে। এতে কি প্রমাণ হয় যে — সবধরণের যৌনাঙ্গ আমভাবে হারাম? নাকি এটা শর্তযুক্ত? আমরা সবাই জানি — স্ত্রী ও দাসীর সাথে সহবাস হারাম না। সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে — এই হাদীসে শর্তযুক্তভাবে যৌনাঙ্গ হারাম হওয়া বোঝাচ্ছে।
- এরপর আশা যাক (হারির) বা রেশম শব্দ নিয়ে। জানা আছে — নারীদের জন্য রেশম জায়েয। আর পুরুষের জন্য অনুর্ধ্ব চার আঙ্গুল পরিমান রেশম ব্যবহার জায়েয।
সুতরাং অলরেডি প্রমাণ হয়ে গেছে যে, এই হাদীসে শর্তহীনভাবে যৌনাঙ্গ কিংবা রেশম হারাম হবার কোন দলিল নেই। একই কথা মা’আযিফ বা বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রেও কেন প্রযোজ্য হবে না?
(গ) এই হাদিসে তো খোদ বাদ্যযন্ত্রের নিন্দা করা হয় নি, বরং এখানে একটা পরিস্থিতির বিবরণ দেয়া হয়েছে। আমরা ইস্তেহলাল শব্দ নিয়ে কথা বলছিলাম। ফাতহুল বারীতে ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী থেকে ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে, এই হাদিসে ইসতেহলাল অর্থ ইসতেরসাল। ইসতেরসাল অর্থ মজে অতিরিক্ত করা অর্থাৎ মদ, রেশম, যৌনতা ও গানবাদ্যে মজে থাকা। আর এই ব্যাখ্যাটাই হাদীসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কারণ এর মাধ্যমে মদ-গাজা-ড্রাগস ও অবাঁধ যৌনতার হারাম বিনোদনে গানবাদ্যের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আর এটা আমরা সবাই স্বীকার করি যে, নাইট ক্লাবগুলো নেশা, যৌনতা ও মিউজিক ছাড়া জমে না। হাদীসে মূলত এই পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিদের অবস্থাই উল্লেখ করা হয়েছে। এসবে যখন বাড়াবাড়ি করবে মানুষ তখন আল্লাহর আযাব নাযিল হবে, এটাই হাদিসের মূল উদ্দেশ্য।
(ঘ) অর্থাৎ গানবাদ্য যখন নেশা, যৌনতার ন্যায় হারাম কাজের সহায়ক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তখনই এই শর্তযুক্ত পরিস্থিতিতে সেটি নিন্দার আওতায় আসবে। অর্থাৎ গানবাদ্য জায়েয হবে নাকি না, সেটা শর্তসাপেক্ষ আলোচনা। এখন বলতে পারো — “তাহলে মদকেও শর্তযুক্তভাবে হালাল বলেন!” এর জবাবে আমরা বলব — এই হাদীসের বাইরে কুরআনের অকাট্য আয়াত, মুতাওয়াতির সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, মদ শর্তহীনভাবে হারাম। অন্যদিকে রেশম ও যৌনাঙ্গ শর্তযুক্তভাবে জায়েয হওয়া ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। তাই আমরা হাদীসের ‘মুতলাক’ (শর্তহীন) কে মুকাইয়াদ (শর্তযুক্ত) করছি। আবার, মা’আযিফ (বাদ্যযন্ত্র) জায়েয হওয়ার ব্যাপারেও অন্যান্য আয়াত ও হাদীসে দলিল আছে, তাই আমরা একেও শর্তযুক্ত করছি, মুকাইয়্যাদ বানাচ্ছি।
আমাদের এই ব্যাখ্যাই যে সঠিক ব্যাখ্যা তা হাদিসের বাকি অংশ থেকে আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ، يَسْتَحِلُّونَ الحِرَ وَالحَرِيرَ، وَالخَمْرَ وَالمَعَازِفَ، وَلَيَنْزِلَنَّ أَقْوَامٌ إِلَى جَنْبِ عَلَمٍ، يَرُوحُ عَلَيْهِمْ بِسَارِحَةٍ لَهُمْ، يَأْتِيهِمْ — يَعْنِي الفَقِيرَ — لِحَاجَةٍ فَيَقُولُونَ: ارْجِعْ إِلَيْنَا غَدًا، فَيُبَيِّتُهُمُ اللَّهُ، وَيَضَعُ العَلَمَ، وَيَمْسَخُ آخَرِينَ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ “
“আমার উম্মতের মধ্যে একদল লোক যৌনাঙ্গ, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে ইসতেহলাল করবে। আর একদল লোক পাহাড়ের পাশে অবতরণ করবে। তারা ভেড়ার পাল চড়াতে বের হবে, এমনসময় তাদের কাছে কোন প্রয়োজনে পড়ে এক ফকীর আসবে। তারা বলবে — কাল আসো। আল্লাহ তাদের উপর রাতে আযাব পাঠাবেন। তাদের উপর পাহাড় ধ্বসিয়ে দিবেন। অন্যদের আকৃতি বিকৃত করে বানর ও শুয়োর বানিয়ে দিবেন।”
প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে — এই হাদীসে আযাবপ্রাপ্ত লোকদের পরিস্থিতি ও বিশেষণ বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। আর এই বিশেষণগুলো হচ্ছে — তারা শরাব, রেশম, অবাধ যৌনতায় লিপ্ত হবে। সাথে এই বিশেষণও এসেছে যে, তারা বাদ্যবাজনা নিয়ে মশগুল থাকবে। এখন এই বাদ্যবাজনার সাথে তো অশ্লীলতা ও মদ-জুয়া জড়িত থাকার কারণে নিন্দা হতে পারে, যেভাবে যৌনতা ও রেশমের ক্ষেত্রে নিন্দা হবে যখন এটি হালালের সীমানা অতিক্রম করে। অর্থাৎ সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে যে, আল্লাহ এই লোকদেরকে তাদের চরম গাফলতি ও দুনিয়া আসক্তির কারণে আযাব দিবেন।
আমরা যদি এই ব্যাখ্যা গ্রহণ না করি তাহলে হাদীসের শেষের বিষয়টার কী ব্যাখ্যা করবে? ফকিরকে ভিক্ষা দেয়া তো মুস্তাহাব। মুস্তাহাব ত্যাগ করা কি হারাম? তাছাড়া ফকিরকে ভিক্ষা দিবে এমনও তো তারা বলে নি, বলেছে আগামীকাল আসতে। এই হাদীসে উল্লিখিত প্রত্যেকটা বিষয়ই আকার বিকৃতি, পাহাড় ধ্বসের উপযুক্ত গুরুতর পাপকাজ হয়, তাহলে ভিখারিকে ভিক্ষা না দেয়াও তো এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাচ্ছে!
সুতরাং এই হাদীসে যেই দুইটি দলের কথা বলা হয়েছে, তারা উভয়েই দুনিয়াবি আসক্তি, বিলাস-ব্যাসন, খায়েশাত পূজা ও নেককাজে গাফিলতির ব্যাপারে চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাবে। প্রথম দল মদ, নারী, রেশম ও বাদ্যে মেতে থাকবে, দ্বিতীয় দল ভেড়ার পালের মালিক তথা অঢেল সম্পদধারী হওয়া সত্তেও দুস্থ-অভাবীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে গড়িমসি করবে। আর তাদের এই অবস্থার কারণেই আল্লাহর শাস্তি হবে।
অনেকেই বলে কেয়ামতের আগে গানবাদ্য হালাল করা হবে! অথচ দলিল-প্রমাণের আলোকে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি যে সাহাবি ও তাবেয়িদের যুগ থেকেই আলেমদের একদল গানবাদ্যকে হালাল মনে করতেন! এমনকি রাসুলের জীবদ্দশাতেই আনসারি সাহাবিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢোল, বাঁশি, তবলা সহ ফূর্তি করেছেন বলে সহীহ সুত্রে ইমাম তাবারি তার তাফসিরে, ইমাম তাহাবি তার শারহু মুশকিলিল আছারে, ইমামা শাফেয়ি তার মুসনাদে, আবু আওয়ানা তার মুসতাখরাজে উল্লেখ করেছেন। এই নিয়েও আমরা অন্য স্থানে কথা বলেছি।
হাদীস ৩ : এরপর তুমি উল্লেখ করেছ -
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِنَّ اللهَ تَعَالَى حَرَّمَ الْخَمْرَ وَالْمَيْسِرَ والكُوْبَةَ.
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত :
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫০৩; বাংলা মিশকাত ৮ম খণ্ড হা/৪৩০৪)।
উত্তর :
এই হাদীসে তোমার অনুবাদক (কুবা) শব্দের অর্থ করেছেন — সব ধরণের বাদ্যযন্ত্র। এটা অনুবাদকের ভ্রান্তি। কারণ কুবা শব্দটি ইয়েমেনিদের মাঝে প্রচলিত ছিল। এর শব্দের প্রসিদ্ধ অর্থ হচ্ছে — নারদ (লুডু খেলা)। হ্যাঁ, এর অন্য আরেক অর্থও হয় — সেটা হচ্ছে ঢোল (তবল) অথবা বারবাত (ছবি : google بربط )
لإمام أبو عبيد القاسم بن سلام الهروي (ت224هـ) في كتابه غريب الحديث ، فقد قال فيه : «وأما الكوبة : فإن محمد بن كثير أخبرني أن الكوبة النرد في كلام أهل اليمن ، وقال غيره الطبل» . غريب الحديث (4/ 278)
ইমাম আবু উবাইদ আল কাসেম বিন সালাম আল হারাবী (মৃ ২২৪) তার গরীবুল হাদীসে বলেন — “কুবা” সম্পর্কে মুহাম্মাদ বিন কাসীর আমাকে জানিয়েছেন যে, ইয়েমেনিদের আঞ্চলিক ভাষায় “কুবা” অর্থ নারদ খেলা। অন্য মতে — এটি হচ্ছে তবল (ঢোল)।
. وقال ابن الأثير في النهاية في غريب الحديث والأثر : « فيه : “إن الله حرم الخمر والكوبة” : هي النرد . وقيل: الطبل. وقيل: البربط».
ইবনে আসীর “নিহায়াহ ফি গরিবিল হাদিস ওয়াল আছার” এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন — কুবা হচ্ছে নারদ খেলা। এছাড়াও বলা হয় — তবল কিংবা বারবাত।
অর্থাৎ ইমাম আবু উবায়দ ও ইবনে আসির দুইজনই কুবার অর্থ নারদ খেলা হওয়াকেই তারজিহ দিচ্ছেন।
হাদীসে উল্লিখিত কুবা অর্থ যে নারদ খেলা (জুয়ার উদ্দেশ্যে) সেটা স্পষ্ট হয় এ হাদীস থেকে। হাদীসটি বুখারী আল আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন :
সালমান বিন শুমাইর আল-আলহানী সাহাবী ফুযালা বিন ওবায়েদ সম্পর্কে বলেন :
«وكان بجمع من المجامع، فبلغه أن أقواما يلعبون بالكوبة، فقام غضبان ينهى عنها أشد النهي، ثم قال: ألا إن اللاعب بها ليأكل ثمرها، كآكل لحم الخنزير، ومتوضئ بالدم. يعني بالكوبة: النرد»
“সাহাবী ফুযালা বিন ওবায়েদ এক জমায়েতে ছিলেন এমন সময় তার কাছে সংবাদ আসল যে, একদল লোক “কুবা” খেলছে। তিনি রেগে দাড়ীয়ে গেলেন এবং কঠোর ভাষায় একে নিষেধ করে বললেন — যারা এটা খেলবে তারা এর মাধ্যমে (জুয়ায় জেতা) অর্থ যে খায় তার দৃষ্টান্ত তার মত যে শুয়োরের রক্তমাখা মাংস খায়। (রাবী বলেন) কুবা হচ্ছে — নারদ খেলা।”
হাদীস ৪ : আল্লাহর রাসুল ও ইবনে উমারের কানে আঙ্গুল দেয়ার ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা।
عَنْ نَافِعٍ قَالَ سَمِعَ ابْنُ عُمَرَ مِزْمَارًا قَالَ فَوَضَعَ إِصْبَعَيْهِ عَلَى أُذُنَيْهِ وَنَأَى عَنْ الطَّرِيقِ وَقَالَ لِي يَا نَافِعُ هَلْ تَسْمَعُ شَيْئًا قَالَ فَقُلْتُ لاَ قَالَ فَرَفَعَ إِصْبَعَيْهِ مِنْ أُذُنَيْهِ وَقَالَ كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم فَسَمِعَ مِثْلَ هَذَا فَصَنَعَ مِثْلَ هَذَا.
নাফে‘ (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
একদা ইবনু ওমর (রাঃ) বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেলে তিনি তাঁর দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হতে সরে গেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে’ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, আমি একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হতে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম (ছহীহ আবূদাঊদ হা/ ৪৯২৪, সনদ ছহীহ)।
উত্তর :
- এই হাদীস থেকে বরং বাদ্যযন্ত্র জায়েয হওয়া প্রমাণ হয় নিম্নোক্ত কারণে -
১. ইমাম ইবনে হাযম এই হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেন -
ولو كان المزمار حراما سماعه لما أباح عليه السلام لابن عمر سماعه. ولو كان عند ابن عمر حراما سماعه لما أباح لنافع سماعه، ولأمر عليه السلام بكسره، ولكنه لم يفعل وإنما تجنب — عليه السلام — سماعه كتجنبه أكثر المباح من أكثر أمور الدنيا: كتجنبه الأكل متكئا، وأن يبيت عنده دينار أو درهم، وأن يعلق الستر على سهوة في البيت، وبالله تعالى التوفيق.
“যদি বাঁশি হারাম হত তিনি (সাঃ) ইবনে ওমরকে শোনার অনুমতি দিতেন না। ইবনে ওমর যদি বাঁশির আওয়াজ শোনা হারাম মনে করতেন তিনি নাফে’কে শোনার অনুমতি দিতেন না। বরং আল্লাহর রাসুল এই বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলার আদেশ দিতেন। কিন্তু তিনি এমন করেন নি। বরং তিনি নিজে এটা শোনা থেকে বিরত থেকেছেন। এটা তেমনই যেমন তিনি অধিকাংশ দুনিয়াবী জায়েয-মুবাহ বিষয় থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখতেন যেমন — হেলান দিয়ে বসে খাওয়া, ঘরে দিনার-দিরহাম জমা রাখা, ঘরের আঙ্গিনায় পর্দা ঝোলানো ইত্যাদি। আল্লাহু আ’লাম।“
২. আল আবুররি মানাকেবে শাফেয়ী গ্রন্থে বর্ণনা করেন :
أخبرنا محمد بن رمضان المصري، أخبرنا ابن عبد الحكم قال:
((قلت للشافعي: في حديث نافع عن ابن عمر أنه مر بزمارة راع فجعل إصبعه في أذنه، وعدل عن الطريق، وجعل يقول: يا نافع أتسمع؟ حتى قلت: لا.
فقال: هكذا كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يفعل.
فقلت: ينبغي لأن يكون حجة في تحريم السماع. فقال الشافعي: لو كان حراماً ما أباح لنافع ولنهاه أن يسمع، ولكنه على التنزه)) .
“আমাকে মুহাম্মদ বিন রমযান আল মাসরি বলেছেন, তাকে ইবনে আব্দুল হাকাম বলেছেন — আমি শাফেয়ীকে জিজ্ঞেস করলাম — ইবন ওমর থেকে নাফে’ যেই হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে আলোচনা আছে যে তিনি রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ফেলেন এবং পথ থেকে সরে যান। এরপর নাফে’কে জিজ্ঞেস করেন — আওয়াজ শোনা যায়, নাফে? অবশেষে নাফে’ বলেন — না শোনা যায় না। এরপর তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসুলও এমন করেছিলেন। আমি বললাম — এই হাদীস (বাদ্যযন্ত্র) শোনা হারাম হওয়ার প্রমান হওয়া উচিত। শাফেয়ী জবাব দিলেন — যদি এটি হারাম হত, তাহলে তিনি নাফে’কে শোনার অনুমতি দিতেন না। বরং তিনি নিজে এটি থেকে বেচে থাকতে চাইতেন।”
৩. আল্লাহর রাসুল বলেছেন, যদি কোন মুনকার বা নিন্দনীয় কাজ হতে দেখ তবে সেটা হাত দিয়ে বাঁধা দাও, যদি না পার তবে হাত দিয়ে, যদি তাও না পারো তবে অন্তরে ঘৃণা কর। এটাই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। মদিনার পথেঘাটে দেদারসে রাখালরা বাঁশি বাজিয়ে বেড়াচ্ছে, আর আল্লাহর রাসুল সেটা নিজ হাতে প্রতিহত করছেন না, এটা কীভাবে সম্ভব হয়? রাসুল না হাত দিয়ে বাঁধা দিচ্ছেন, না মুখ দিয়ে সেই রাখালকে থামতে বলছেন! রাসুল কি মদিনাতে এতই দূর্বল ছিলেন। গোটা আরব যিনি জয় করে ফেলেছেন, তিনি কি সামান্য একজন রাখালের বাঁশি বাজানো বন্ধ করতে পারলেন না? এ থেকে ইবনে হাযমের ব্যাখ্যাই সঠিক প্রমাণ হল যে, রাসুলের দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি থেকেই বাদ্য শোনা থেকে বিরত থেকেছেন। হারাম হবার কারণে না।
মিউজিক হারাম হবার পক্ষে আরো অনেক হাদিস ও আছার উল্লেখ করা হয়। এদের মধ্যে যেই বর্ণনাগুলো বিশুদ্ধ সেগুলোতে গানবাদ্য হারাম হবার ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন কথা নেই। আর যেগুলোতে সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে সেগুলো একটা বিশুদ্ধ হাদিস না। সেগুলো খণ্ডন করতে গেলে স্বতন্ত্র বই লেখা প্রয়োজন হবে। সংক্ষিপ্ততার জন্য আমরা এই সম্পর্কে কয়েকজন ইমামের বক্তব্য উল্লেখ করে ইতি টানছি।
১। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবি আল মালেকি “আল-আহকাম” এ বলেছেন :
لم يصح في تحريم المعازف شيء .
“বাদ্যযন্ত্রের নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক কোন হাদিসই সহিহ নয়।”
২। ইমাম গাযালী ও ইবনুন নাহবি “আল-উমদা”তে ঠিক একই কথাই বলেছেন।
৩। ইবন তাহির লিখেছেন:
لم يصح من أدلة تحريم المعازف حرفٌ واحد.
বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করে যেসব দলিল দেয়া হয় সেগুলোর একটা অক্ষরও বিশুদ্ধ নয়।
৪। ইবন হাযমের উক্তি,
كل ما رُوي في تحريم المعازف باطلٌ وموضوعٌ
বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করে যত যা বর্ণিত হয়, তার সবগুলোই বাতিল ও বানোয়াট।
প্রথমে আবু উমামার হাদীস নিয়ে কথা বলা যাক।
হাদীস ১: তুমি নিচের হাদিসটি উল্লেখ করেছ।
عَنْ أَبِيْ اُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لاَ تَبِيْعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوْهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوْهُنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ.
আবু ওমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় কর না, তাদের ক্রয় কর না, তাদের গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিয়ো না, তাদের উপার্জন হারাম’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৮০)।
উত্তর :
- এই হাদীস দয়ীফ জিদ্দান (অতি দূর্বল), এমন হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ দেয়া জায়েয নয়। মিশকাতে এই হাদীস উল্লেখ করে গ্রন্থকার বলেন:
رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَقَالَ التِّرْمِذِيُّ هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَعلي بن يزِيد الرواي يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ
“হাদীসটি আহমদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযি বলেছেন — এটি গরীর (একক সুত্রে বর্ণিত) হাদীস। আর বর্ণনাকারী আলী বিন ইয়াযীদ হাদীসে দূর্বল।”
চল, এবার তিরমিযীর কিতাবে যাই, দেখি তিনি কী বলেন -
قال أبو عيسى حديث أبي أمامة إنما نعرفه مثل هذا من هذا الوجه وقد تكلم بعض أهل العلم في علي بن يزيد وضعفه وهو شامي.
“আবু ঈসা (তিরমিযী) বলেন — আবু উমামার এই হাদীসটি আমরা একে কেবল এই একটি সুত্রে জানি। বেশ কিছু আহলে ইলম আলী বিন ইয়াযীদের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন এবং তাকে দয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন।”
তো আহলে ইলমরা এই আলী বিন ইয়াযীদের ব্যাপারে কী বলেছেন, ইমাম যাহাবীর মীযানুল এ’তেদাল থেকে দেখা যাক -
قَالَ الْبُخَارِيُّ مُنْكَرُ الْحَدِيثِ
وَقَالَ النَّسَائِيُّ لَيْسَ بِثِقَةٍ
وقَالَ أَبُو زُرْعَةَ لَيْسَ بِقَوِيٍّ
وقَالَ الدَّارَقُطْنِيُّ مَتْرُوكٌ
বুখারী বলেছেন — তার হাদীস মুনকার।
নাসায়ী বলেছেন — নির্ভর অযোগ্য।
আবু যুর’আহ বলেছেন — শক্তিশালী নয়।
দারাকুতনী বলেছেন — পরিত্যাজ্য।
তোমার মনে প্রশ্ন হতে পারে — এমন হাদীসকে কোন যুক্তিতে তোমার বইয়ে সহীহ হাদীস বলা হয়েছে? — আসলে এটা আলবানীর তাকলীদ করে করা। আলবানী সিলসিলায়ে সহীহাতে এই হাদীসটা উল্লেখ করে একে দূর্বল বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি একে অন্য এক হাদীসের সাহায্য নিয়ে দয়ীফ থেকে হাসান লি-গায়রিহি প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। এটা আলবানীর তাহকীক করার মানহাজে বড় ধরণের ত্রুটি। কারণ মাতরুক, মুনকার, গায়রে সিকাহ রাবীর হাদীসকে হাসান লি-গায়রিহি বানানো যায় না।
দেখো, ইবনে হাজার কী লিখেছেন -
ثم الطعن: إمَّا أنْ يَكُونَ:
1- لِكَذِبِ الرَّاوِي. 2- أَوْ تُهْمَتِهِ بِذلِكَ. 3- أوْ فُحْشِ غَلَطِهِ.
4- أَوْ غَفْلَتِهِ. 5- أَوْ فِسْقِهِ. 6- أَوْ وَهْمِهِ.
7- أَوْ مُخَالَفَتِه. 8- أَوْ جَهَالَتِه. 9- أَوْ بِدْعَتِهِ. 10- أو سُوءِ حِفْظِهِ.
فالأوَّلُ: الْمَوْضُوعُ، والثَّانِي: الْمَتْرُوكُ. والثَّالِثُ: المُنْكَرُ، عَلَى رَأْيٍ. وكَذَا الرَّابِعُ والخَامِسُ
অর্থাৎ রাবীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ১০টি স্তর আছে। সবচেয়ে মারাত্মক স্তর হল ১ নম্বর, সবচেয়ে কম মারাত্মক হল ১০ নম্বর।
১. যে রাবী মিথ্যা বলে তার হাদীসকে মাওদ্বু বলা হয়।
২. যার ব্যাপারে মিথ্যা বলার অভিযোগ থাকে, তাকে মাতরুক বলা হয়।
৩, ৪, ৫. যার বর্ণনায় মারাত্মক রকম ভূল থাকে, তার হাদীসকে মুনকার বলা হয়। একইভাবে সঠিকভাবে হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে গাফেল হলে কিংবা ফাসেক হলে, তার হাদীসকে মুনকার বলা হয়।
তোমার দেয়া হাদীস হচ্ছে — মাতরুক ও মুনকার রাবী আলী বিন ইয়াযীদের হাদীস। এমন লোকের হাদীসকে হাসান লি-গায়রিহি বানানো যায় না। কারণ হাসান লি-গায়রিহি বানানোর শর্ত হচ্ছে -
وَمَتَى تُوبِعَ سَيِّءُ الْحِفْظِ بِمُعْتَبَرٍ، وَكَذَا الْمَسْتُورُ، وَالْمُرْسَلُ، وَالْمُدَلَّسُ: صَارَ حَدِيثُهُمْ حَسَناً لا لِذَاتِهِ، بَلْ بالْمَجْمُوع.
অর্থাৎ দয়ীফ হাদীস হাসান লি-গায়রিহি হবে যদি দয়ীফ হাদীসের রাবী দূর্বল স্মৃতিবিশিষ্ট রাবী অথবা মাসতুর (এমন রাবী যার নাম বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় কিন্তু তিনি সিকাহ এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় না) অথবা মুদাল্লিস হয়। অর্থাৎ ৯ ও ১০ নং স্তরের রাবীর হাদীসকেই কেবল অন্য হাদীস দিয়ে হাসান লি-গায়রিহি বানানো যায়। এর উপরের স্তরে যারা আছে, তাদের হাদীস দিয়ে নয়।
আহমদ শাকের এটা খোলাসা করে ‘আল বা’য়েস আল হাসীস’ কিতাবের টীকায় লিখেন -
“ وبذلك يتبين خطأ كثير من العلماء المتأخرين في إطلاقهم أن الحديث الضعيف إذا جاء من طرق منعددة ضعيفة ارتقى إلى درجة الحسن أو الصحيح، فإنه إذا كان ضعف الحديث لفسق الراوي أو اتهامه بالكذب ، ثم جاء من طرق أخرى من هذا النوع ،ازداد ضعفا إلى ضعف ، لأن تفرد المتهمين بالكذب أو المجروحين في عدالتهم بحيث لا يرويه غيرهم يرفع الثقة بحديثهم ، ويؤيد ضعف روايتهم ، وهذا واضح .”
“
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرِ بْنِ سُفْيَانَ الرَّقِّيُّ، ثنا أَيُّوبُ بْنُ مُحَمَّدٍ الْوَزَّانُ، ح وحَدَّثَنَا عَبْدَانُ بْنُ أَحْمَدَ، ثنا الْعَبَّاسُ بْنُ الْوَلِيدِ الْخَلَّالُ الدِّمَشْقِيُّ، قَالَا: ثنا الْوَلِيدُ بْنُ الْوَلِيدِ، ثنا ابْنُ ثَوْبَانَ، عَنْ يَحْيَى بْنِ الْحَارِثِ، عَنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمْ: «لَا يَحِلُّ بَيْعُ الْمُغَنِّيَاتِ وَلَا شِرَاؤُهُنَّ، وَلَا تِجَارَةٌ فِيهِنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ»
এই হাদীসে আছে — আল ওলীদ বিন আল ওলীদ এবং ইবনে সাওবান। এই দুইজনেই দূর্বল। অথচ আলবানী বলছেন -
قلت: وهذا إسناد حسن، الوليد بن الوليد هو
العنسي القلانسي الدمشقي، قال ابن أبي حاتم (4 / 2 / 19) عن أبيه: “ صدوق،
ما بحديثه بأس، حديثه صحيح “. ومن فوقه معروفون من رجال التهذيب على كلام في
بعضهم
তিনি আল ওলীদের পক্ষে কেবল ইবনে আবি হাতেমের তা’দীল উল্লেখ করছেন। ভালো কথা। কিন্তু এর উপরের রাবীদের ব্যাপারে? আলবানী বলছেন — “উপরের রাবীরা তাহযীব কিতাবের পরিচিত রাবী, তবে তাদের কারো কারো ব্যাপারে মন্তব্য আছে।” কী সেই মন্তব্য সেটা তিনি উল্লেখ করেন নি। চল আমরা সেটা ইবনে হাজার লিখিত তাহযীবুত তাহযীবে থেকে দেখে নেই -
قال الأثرم عن أحمد أحاديثه مناكير
আসরাম ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণনা করেন — তার হাদীসগুলো মুনকার।
وقال محمد بن الوراق عن أحمد لم يكن بالقوي في الحديث
মুহাম্মদ বিন ওয়াররাক ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন — সে হাদীসে শক্তিশালী নয়।
وقال الدوري عن ابن معين والعجلي وأبو زرعة الرازي لين وقال معاوية بن صالح عن ابن معين ضعيف
দাওরী বর্ণনা করেন ইবনে মাঈন, আল ‘আজলী, আবু যুর’আহ বলেছেন : সে নরম/সহজতকারী। মুয়াবিয়া বিন সালেহ বর্ণনা করেন : ইবনে মাঈন বলেছেন — সে দূর্বল।
وقال النسائي ضعيف وقال مرة ليس بالقوي وقال مرة ليس بثقة
নাসায়ী বলেন — সে দূর্বল, আরেকবার বলেছেন — সে শক্তিশালী নয়, আরেকবার বলেছেন — সে সিকাহ (নির্ভরযোগ্য) নয়।
অর্থাৎ আলবানী তিরমিযির দয়ীফ হাদীসকে যেই হাদীসের ভিত্তিতে হাসান বলার চেষ্টা করেছেন সেটা নিজেও দূর্বল। একজন মুনকার, মাতরুক রাবীর হাদীস অন্য আরেক দূর্বল রাবীর বর্ণনা দিয়ে হাসান হয় না।
এবার আসা যাক আল ওলীদের প্রসঙ্গে। আলবানী তো তার পক্ষে ইবনে আবি হাতেমের পক্ষে তা’দীল উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অন্য ইমামরা কী বলেছেন? মুসনাদে আহমদের তাহকীকে তোমার দেয়া হাদীসের ইসনাদ আলোচনায় শু’আইব আরনাউত ও তার সহকর্মীরা লিখেছেন -
وأخرجه الطبراني في “الكبير” (7749) ، وفي “الشاميين” (321) و (893) من طريق الوليد بن الوليد -وهو العنسي الدمشقي- عن عبد الرحمن بن ثابت ابن ثوبان، عن يحيى بن الحارث الذماري، عن القاسم، به. قلنا: الوليد بن الوليد قال فيه الدارقطني: منكر الحديث.
তাবারানী এই হাদীস মুজামে কবীরে ও শামিয়্যিন কিতাবে এনেছেন আল ওলীদ বিন আল ওলীদের সুত্রে। এই আল ওলীদ বিন আল ওলীদ হলেন আল আনসী আদ দিমাশকি। তিনি বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমাত বিন সাবেত বিন সাওবান বিন হারেস আল যিমারী থেকে, তিনি আল কাসেম থেকে। আমরা বলি — এই আল ওলীদ বিন আল ওলীদের ব্যাপারে দারাকুতনী বলেছেন — “তার হাদীস মুনকার”।
এবার তুমিই বল এক মুনকার রাবীর হাদীসকে কীভাবে আরেক মুনকার রাবীর হাদীস দিয়ে আলবানী হাসান বানালেন? আর কীভাবে তোমার দেয়া বইয়ের লেখক আলবানীর হাসান লি গায়রিহি বলাকে সহীহ বানালেন? হয়ত তোমার দেয়া বইয়ের লেখক দেখছেন যে, এটা আলবানীর সিলসিলা সহীহাতে আছে। ব্যস, একে সহীহ বানিয়ে দিয়েছেন। খুবই সস্তা মানের লেখক হবে হয়ত।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই এই হাদীস গ্রহণযোগ্য তবুও এতে বাদ্যযন্ত্র হারাম প্রমাণ হয় না। বরং গায়িকা দাসী কেনা-বেচা নিষেধ বোঝা যায় কেবল। তুমি মেশকাত কিতাবের রেফারেন্স উল্লেখ করেছ।
মেশকাতের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন -
(ولَا تَبِيعُوا الْقَيْنَاتِ) : بِفَتْحِ الْقَافِ وَسُكُونِ التَّحْتِيَّةِ : فِي الصِّحَاحِ: الْقَيْنُ الْأَمَةُ مُغَنِّيَةً كَانَتْ أَوْ غَيْرَهَا (وَلَا تَشْتَرُوهُنَّ) قَالَ التُّورِبِشْتِيُّ: وَفِي الْحَدِيثِ يُرَادُ بِهَا الْمُغَنِّيَةُ، لِأَنَّهَا إِذَا لَمْ تَكُنْ مُغْنِيَةً فَلَا وَجْهَ لِلنَّهْيِ عَنْ بَيْعِهَا وَشِرَائِهَا (وَلَا تُعَلِّمُوهُنَّ) أَيِ الْغِنَاءَ فَإِنَّهَا رُقْيَةُ الزِّنَا (وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ) قِيلَ: لَا يَصِحُّ بَيْعُهُنَّ لِظَاهِرِ الْحَدِيثِ، وَقَالَ الْقَاضِي: النَّهْيُ مَقْصُورٌ عَلَى الْبَيْعِ وَالشِّرَاءِ لِأَجْلِ التَّغَنِّي، وَحُرْمَةُ ثَمَنِهَا دَلِيلٌ عَلَى فَسَادِ بَيْعِهَا، وَالْجُمْهُورُ صَحَّحُوا بَيْعَهَا، وَالْحَدِيثُ مَعَ مَا فِيهِ مِنَ الضَّعْفِ، لِلطَّعْنِ فِي رِوَايَتِهِ مُؤَوَّلٌ بِأَنَّ أَخْذَ الثَّمَنِ عَلَيْهِنَّ حَرَامٌ كَأَخْذِ ثَمَنِ الْعِنَبِ مِنَ النَّبَّاذِ ; لِأَنَّهُ إِعَانَةٌ وَتَوَصَّلٌ إِلَى حُصُولِ مُحَرَّمٍ، لَا لِأَنَّ الْبَيْعَ غَيْرُ صَحِيحٍ. اهـ.
“(তোমরা ‘কাইন’দের বিক্রি করো না) — ক্বাফ যবর, ইয়া সাকীন দিয়ে উচ্চারণ হবে। সিহাহ অভিধান অনুযায়ী — কাইন হচ্ছে দাসী, চাই সে গায়িকা হোক অথবা না হোক।
(তাদের খরিদ করো না) — তুরিবিশতি বলেন — এই হাদীসের উদ্দেশ্য হচ্ছে গায়িকা দাসী। কারণ দাসী যদি গায়িকা না হয়, তবে তার কেনা-বেচা নিষিদ্ধ হবার কোন যুক্তি নেই।
(তাদেরকে) গান (শিখিও না) — কেননা এটি যেনা-ব্যাভিচারের জন্য উস্কানী হবে।
(তাদের মূল্য গ্রহণ হারাম) — কেউ কেউ বলেন — হাদীসের বাহ্যিক অনুযায়ী তাদের বিক্রি করা শুদ্ধ হবে না। কিন্তু আল কাযি বলেছেন — এখানে কেনা-বেচা নিষেধ করা হয়েছে গান গাওয়ার কারণে। আর হাদীসে যেহেতু মূল্যকে হারাম বলা হয়েছে, এতে বোঝা যায় যে, বেচাবিক্রি শুদ্ধ হবে না। কিন্তু জুমহুর আলেম বলেছেন — বিক্রি শুদ্ধ হবে, এই হাদীস দূর্বল এবং এর রেওয়ায়াত প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু তারপরেও একে গ্রহণ করা যায়, তবে এভাবে তাবীল করে — তাদের মূল্যগ্রহণ করা সেই অর্থে হারাম যেই অর্থে নাবিয বানানোর জন্য আঙ্গুর বিক্রির মূল্য গ্রহণ হারাম। কেননা এখানে একটি জায়েয কাজকে হারামে সহযোগী হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে। বিক্রি শুদ্ধ না একারণে হারাম নয়।”
- মোল্লা আলী কারীর মেরকাত থেকে সমাপ্ত।
এখন প্রশ্ন জাগে, দাসীর গান শোনা কি শর্তহীনভাবে হারাম? নাকি মনিবের জন্য জায়েয এবং অন্য পুরুষের জন্য হারাম? হারাম হলে কেন হারাম?
প্রথম প্রশ্নে আসা যাক — দাসীর গান শোনা কি হারাম?
- তোমার সাথে আমার মতভেদ হচ্ছে বাজনা নিয়ে। গান নিয়ে নয়। কারণ গানকে তুমিও জায়েয বল। তাই এই হাদীস আমার বিরুদ্ধে যায় না এবং কিছু প্রমাণও হয় না।
এবার পরের প্রশ্ন দুইটি দেখা যাক।
আল্লামা মুনাভী “ফায়দ্বুল কাদীর” কিতাবে এর উত্তর দিয়েছেন -
প্রথমে তিনি জামে’উস সগীরের এই হাদীসটি উল্লেখ করেন -
لله أشد أذنا إلى الرَّجُلِ الحَسَنِ الصَّوْتِ بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ مِنْ صاحب القينة إلى قَيْنَتِهِ
“মনিব তার (গায়িকা) দাসীর গান যত মনোযোগ দিয়ে শোনে আল্লাহ তা’আলা সুমিষ্ট কণ্ঠে কুরআন পাঠকের কুরআন পাঠ তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে শোনেন।” [মুসতাদরাকে হাকেমে এই হাদীসকে ইমাম হাকেম সহীহ হাদীস বলেছেন]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মুনাভী বলেন -
وفيه حل سماع الغناء من قينته ونحوها لأن سماع الله لا يجوز أن يقاس على محرم وخرج بقينته فينة غيره فلا يحل سماعها بل يحرم إن خاف ترتب فتنة
“এই হাদীস থেকে বোঝা যায় — নিজ দাসীর কণ্ঠে গান শোনা হালাল। কারণ যদি এটা হারাম হত, তাহলে একটা হারাম কাজ শোনার সাথে আল্লাহ তায়ালার শোনাকে তুলনা করা হত না। আর হাদীসে নিজের দাসী বলা হয়েছে, এ থেকে বোঝা যায় অন্যের দাসীর কণ্ঠে গান শোনা হালাল হবে না, বরং ফিতনার আশংকা থাকলে হারাম হবে।” (সমাপ্ত)
আমি (শেখ সাদী) বলি — এই ফিতনার আশংকাকে মোল্লা আলী কারী যেনা-ব্যাভিচারের উস্কানী বলেছেন।
সুতরাং, এই হাদীসকে প্রথমত গ্রহণযোগ্য ধরার কোন সুযোগ নেই। মুনকার রাবীর হাদীস। আর যদি গ্রহণযোগ্য ধরিও তবু এটা বাদ্যযন্ত্রের বিপক্ষে যায় না, বরং অন্য পুরুষের দাসীর কন্ঠে গান শোনা হারাম বোঝা যায়। আবার এটাও যেনা ও ফেতনার আশংকার কারণে।
হাদীস ২ : তুমি আরো উল্লেখ করেছ -
عنْ أَبِيْ مَالِكِ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لَيَكُوْنَنَّ مِنْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّوْنَ الْحِرَ وَالْحَرِيْرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ.
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ ‘অবশ্যই অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে যারা যেনা, রেশম, নেশাদার দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’ (বুখারী হা/৫৫৯০)।
উত্তর :
(ক) সনদের দিক থেকে আলোচনা —
১। হাদিসটি বুখারির “সহীহ” এর অন্তর্ভূক্ত নয়। ইমাম বুখারী তার কিতাবে বিভিন্ন পরিচ্ছেদের শুরুতে মু’আল্লাক হাদিস উল্লেখ করে থাকেন। মূল বর্ণনাকারীর ও ইমাম বুখারীর মাঝে যখন অবিচ্ছিন্ন সংযোগ না থাকে, তখন তাকে মুয়াল্লাক হাদীস বলা হয়। হাদিসটি বর্ণনা করার সময় ইমাম বুখারীর নিজের দিকে নিসবত করেন নি। অর্থাৎ তিনি বলেন নি “হাদ্দাসানা হিশাম …” (হিশাম আমাদের বলেছেন)। বরং তিনি নিজের সম্পৃক্তি বাদ দিয়ে বলেছেন “ক্বালা হিশাম …” (হিশাম বলেছেন)
২। সঙ্গীতকে যারা হারাম বলে তাদের বক্তব্য হচ্ছে সহীহুল বুখারীতে ইমাম বুখারী নিজের দিকে সম্পৃক্ত না করলেও তিনি অন্যান্য গ্রন্থে, যেমন — তারীখে কাবীরে তিনি নিজের দিকে নিসবত করে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। এর জবাবে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে — হাদীসটি ইমাম বুখারী তার সহীহ’তে পূর্ণাঙ্গ সনদে (মুসনাদ) হিসেবে উল্লেখ না করে মুয়াল্লাক হিসেবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল হাদীসের মাঝে বিদ্যামান ইল্লত বা ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করা। যার বৃত্তান্ত হচ্ছে –
(ক) হাদীসের সনদে আছে তাবেয়ির স্তরে আছেন আতিয়্যাহ বিন কায়েস। তাহরিরু তাকরিবিত তাহযিব গ্রন্থে শুয়াইব আরনাউত ও বাশশার আওয়াদ বলছেন, صدوق حسن الحديث ولم يؤثر توثيقه عن كبير أحد من الأئمة وروى عنه جمع وذكره إبن حبان في الثقات
“সত্যবাদী। তার হাদীস হাসান। তবে বড় কোন ইমাম থেকে তার নির্ভরযোগ্যতার (সিকাত) ব্যাপারে কিছু বর্ণিত হয় নি। তবে অনেকেই তার সুত্রে বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান তাকে সিকাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।” কিন্তু ইবনে হিব্বান তার সিকাত গ্রন্থে অনেক সহজতার পরিচয় দেন, এমনকি অজ্ঞাত অবস্থার বহু রাবীকে উল্লেখ করে থাকেন এটা মুহাদ্দিসদের মাঝে প্রসিদ্ধ বিষয়। আলবানী, মুয়াল্লিমী, মুকবিল বিন হাদী প্রত্যেকেই এই কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যগুলো নিচে দেয়া হল।
قال الالباني رحمه الله (سلسلة الأحاديث الصحيحة) (2/ رقم 633/ ص218–219):
(العجلي معروف بالتساهل في التوثيق ، كابن حبان تماماً ، فتوثيقه مردود إذا خالف أقوال الأئمة الموثوق بنقدهم وجرحهم)
قال العلامة عبدالرحمن المعلمي رحمه الله في (التنكيل)(1/66)
( و العجلي قريب منه- أي ابن حبان- في توثيق المجاهيل من القدماء).
وقال الشيخ مقبل بن هادي الوادعي رحمه الله في كتابه (المقترح في أجوبة بعض أسئلة المصطلح)( رقم 32/37–38)
(الذي يوثقه أحدهما أو كلاهما — ابن حبان والعجلي — فقد لا يكون بمنزلة صدوق، ويصلحُ في الشواهد والمتابعات، وإن كان العجلي يعتبر أرفعُ في هذا الشأن، فهما متقاربان).إنتهى
ইবনে হিব্বান ছাড়াও আবু হাতেম ও বাযযার আলোচ্য রাবীর ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেছেন। আবু হাতেম বলেছেন صالح الحديث (সালেহুল হাদিস) তার হাদিস চলে, বাযযার বলেছেন لا بأس به (লা বা`সা বিহি) তার সমস্যা নেই। হাদীস শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, এই দুইটি বিশেষণ বোঝায় যে, রাবী হিসেবে আতিয়্যাহ বিন কায়েস নিম্নপর্যায়ের। একজন রাবী নির্ভরযোগ্য হবার জন্য তার মাঝে দুটো জিনিস খোঁজা হয় — আদালত (ন্যায়পরায়ণতা) এবং দ্ববত (স্মৃতি ও সংরক্ষণ)। যেসব রাবীদের আদালতে সমস্যা না থাকে, কিন্তু দ্ববতে সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রেই উপরে উল্লিখিত বিশেষণ দুটো ব্যবহার করা হয়।
ইবনে আবি হাতেম তার “আল জারহু ওয়াত তা’দীল” গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ২৭তম পৃষ্ঠায় বলেছেন,
ذكر ابن ابي حاتم في مقدمة الجزء الأول من “ الجرح و التعديل “ « ص 27 » ما نصه
«و وجدت الألفاظ في الجرح و التعديل على مراتب شتى ، فإذا قيل للواحد :
إنه ثقة ، أو متقن ، أو ثبت ، فهو ممن يحتج بحديثه،
و إذا قيل : إنه صدوق ، أو محله الصدق ، أو لا بأس به، فهو ممن يكتب حديثه، وينظر فيه، و هي المنزلة الثانية
و إذا قيل : شيخ فهو بالمنزلة الثالثة ، يكتب حديثه و ينظر فيه ، إلاأنه دون الثانية،
وإذا قيل : صالح الحديث ، فإنه يكتب حديثه للاعتبار
“আমি লক্ষ্য করেছি জারহ ও তাদীলের (বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা বিচারের) ক্ষেত্রে অনেকগুলো স্তর রয়েছে।
যখন কারো ব্যাপারে বলা হয় তিনি সিকাহ (নির্ভরশীল) কিংবা মুতকিন (পারঙ্গম) কিংবা সাবাত (প্রামাণ্য), তখন তার বর্ণিত হাদিস প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তবে যদি কারো ব্যাপারে বলা হয় — সদুক (সত্যবাদী) কিংবা মাহাল্লুহুস সিদক (সত্যে অবস্থিত) কিংবা লা বা`সা বিহি (তার সমস্যা নেই), তবে তার বর্ণিত হাদিসগুলো লেখা হয় এবং দেখা হয়। তবে এটি দ্বিতীয় স্তরের।
অন্যদিকে যদি শায়খ বলা হয়, তবে এটি তৃতীয় স্তরের। তার হাদিস লেখা ও দেখা হয়। তবে এটি দ্বিতীয় স্তরের নিচে।
আর যদি বলা হয় সালেহুল হাদীস (তার হাদিস চলে), তবে তার হাদিস ইতেবার হিসেবে লেখা হয়। (উসুলে হাদিসের পরিভাষা অনুযায়ী ইতেবার অর্থ কোন একটি হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা বিচারের জন্য যখন সাক্ষ্য হিসেবে অন্যান্য হাদিস খোঁজা হয়)”
তাহলে দেখা যাচ্ছে জারহ তাদিলের কোন ইমামই আতিয়্যাহ বিন কায়েসের বর্ণিত হাদীসকে প্রামাণ্য বলেন নি, আবু হাতেম বলেছেন সালেহুল হাদীস অর্থাৎ চতুর্থ শ্রেণীর রাবী, বাযযার বলেছেন লা বা`সা বিহি অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর রাবী। মুহাদ্দিসদের মাঝে সুবিদিত আছে যে, আবু হাতেম রাবীদের ক্ষেত্রে কঠোরতা করতেন আর বাযযার করতেন সহজতা। সুতরাং আতিয়্যাহ বিন কায়েস দ্বিতীয় ও চতুর্থের মাঝামাঝি হওয়াই যৌক্তিক। তবে ইবনে হাজার তাকরিব গ্রন্থে তাকে সিকাহ বলেছেন এবং এটা ইবনে হাজারের ভুল ছিল। কারণ তিনি ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আতিয়্যাহ বিন কায়েসের ব্যাপারে আবু হাতেমের বক্তব্যের উপর নির্ভর করেছেন। আর আবু হাতেম তাকে শক্তিশালী সাব্যস্ত করেছেন। অথচ আবু হাতেমের বক্তব্য সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি যে, তার মতে আতিয়্যাহ বিন কায়েস চতুর্থ শ্রেণীর রাবী।
(খ) উপরোক্ত আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কেউ বলতে পারেন যে, আতিয়্যাহ বিন কায়েসকে তো কেউ যইফ বলেন নি। তার হাদিস সহিহ না হলেও অন্তত হাসান পর্যায়ের তো হবে। আর হাসান হাদিস তো গ্রহণযোগ্য! এর উত্তর হচ্ছে, উপরের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল রাবী হিসেবে আতিয়্যাহ বিন কায়েসের দ্ববত (স্মৃতি ও সংরক্ষণ) নিয়ে প্রশ্ন তোলা। এই হাদীসটি নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে ধরা পরে যে, এই হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আতিয়্যাহ বিন কায়েস ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। কীভাবে? হাদিসটি তিনি ঠিক কোন সাহাবির কাছ থেকে শুনেছেন সেটা মনে রাখতে পারেন নি। তিনি সন্দেহ করেছেন যে, তিনি এটি আবু আমের আশআরীর কাছ থেকে শুনেছেন নাকি আবু মালেক আশআরীর কাছ থেকে। এছাড়াও এই হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ নিয়েও তার বর্ণনায় অসংলগ্নতা আছে। কোন কোন বর্ণনায় حر (হির) শব্দটি এসেছে, কোন কোন বর্ণনায় এসেছে নুক্তাযুক্ত অবস্থায় خز (খায), যেমন আবু দাউদে। ইমাম আবু দাউদ এই হাদিসটি উল্লেখ করার পর বলেছেন যে, প্রায় ত্রিশের মত সাহাবি খায (এক ধরণের পোশাক) পরিধান করেছেন। অর্থাৎ হাদিসটি যে উল্লতযুক্ত তিনি তা স্পষ্ট করেছেন।
(গ) ইমাম বুখারী এই হাদিসটি তারীখে কাবীরে বলেছেন হাদীসটি আবু আমের নয়, আবু মালেক আশআরী থেকেই প্রসিদ্ধ। আমরা যদি আতিয়্যাহ বিন কায়েস বাদ দিয়ে এই হাদিসটির অন্যান্য সুত্র সন্ধান করি তবে মালেক বিন আবি মারইয়ামের বর্ণনা খুঁজে পাই, যা সুনানে আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহতে উল্লিখিত আছে। ইবনে মাজাহতে আছে –
عَنْ مَالِكِ بْنِ أَبِي مَرْيَمَ قَالَ: «دَخَلَ عَلَيْنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ غَنْمٍ، فَتَذَاكَرْنَا الطِّلَاءَ فَقَالَ: حَدَّثَنِي أَبُو مَالِكٍ الْأَشْعَرِيُّ : أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَيَشْرَبَنَّ نَاسٌ مِنْ أُمَّتِي الْخَمْرَ يُسَمُّونَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا يُعزَف على رؤوسهم بالمعازف والمغنيات، يخسف الله بهم الأرض، ويجعل منهم القردة والخنازير”. »
মালেক বিন আবি মারইয়াম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আব্দুর রহমান বিন গানাম আমাদের কাছে আসেন এবং তিলা-র (নেশাদ্রব্য) কথা উল্লেখ করে বলেন, আবু মালেক আশআরী আমাকে বলেছেন, তিনি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, “আমার উম্মতের এক কিছু লোক মদ খাবে এবং একে ভিন্ন নামে ডাকবে। তাদের মাথার উপরে বাদ্য বাজবে ও গায়িকারা থাকবে। তাদের যমিনে ধসিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের কাউকে বানর ও শুকড় বানিয়ে দেয়া হবে।”
বুখারীতে বর্ণিত আতিয়্যাহ বিন কায়েসের বর্ণিত হাদিসের সাথে মালেক বিন আবি মারইয়ামের বর্ণিত এই হাদীসের স্পষ্ট পার্থক্য আছে। এই হাদীসে বলা নেই যে, গানবাদ্যকে হালাল করা হবে। বরং মদের নাম পাল্টে দিয়ে সেটা পান করার ব্যাপারে হাদিসের এই শাস্তির কথা আছে। তাছাড়া ইমাম বুখারী নিজে যখন আতিয়্যাহ বিন কায়েসের মুয়াল্লাক হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তখন তিনি শিরোনাম দিয়েছেন بَابُ مَا جَاءَ فِيمَنْ يَسْتَحِلُّ الْخَمْرَ وَيُسَمِّيهِ بِغَيْرِ اسْمِهِ “মদকে যারা হালাল করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে” গানবাদ্য হারাম করার শিরোনামে সহীহ বুখারীতে কোন হাদিস ইমাম বুখারী উল্লেখ করেন নি। এছাড়াও ইমাম বুখারীর উল্লিখিত ত্রুটিযুক্ত হাদিসটি যে স্বয়ং প্রামাণ্য নয়, বরং এই হাদিসটি তিনি মদ হালাল করা সংক্রান্ত হাদিসের পক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন এটা ইমাম মিযযি তার তাহযিবুল কামালে আতিয়্যাহ বিন কায়েসের আলোচনায় বলেছেন استشهد له البخاري بحديث واحد “বুখারী ইসতেশহাদ বা সাক্ষ্য হিসেবে তার একটি হাদিস ব্যবহার করেছেন” ইসতেশহাদ ও ইহতেজাজ এই দুইয়ের মাঝে তফাত হল, প্রথম ক্ষেত্রে হাদীসটি নিজে প্রমাণ হয় না, তবে অন্য কোন হাদিসের পক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হয়। অন্যদিকে ইহতেজাজ হল যখন খোদ হাদীসটি নিজেই প্রামাণ্য হয়।
২. সনদের দিক থেকে হাদিসটি যে ত্রুটিযুক্ত এটা প্রমাণ হবার পর আসা যাক, হাদিসের মতন নিয়ে আলোচনায়।
(ক) এই হাদীসে ইস্তেহলাল শব্দ থেকে মা’আযিফ (music) হারাম প্রমাণ হয় না। কারণ ইস্তেহলালের একাধিক অর্থ আছে। কখনো হালালকে হালাল হিসেবে গণ্য করা অর্থও হয়। উদাহরণ ইবনে হিব্বানের সহীহ হাদীস -
يوشك أحدكم أن يكذبني وهو متكئ على أريكته يحدث بحديثي، فيقول: بيننا وبينكم كتاب الله، فما وجدنا فيه من حلال استحللناه، وما وجدنا فيه من حرام حرمناه
“এমন এক সময় আসবে যখন আসনে হেলান দিয়ে কিছু লোক আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। তাকে যখন আমার হাদীস বলা হবে, সে বলবে — আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব আছে। এটাই যথেষ্ট। এতে আমরা যাকে হালাল পেয়েছি তাকে “ইস্তেহলাল” (হালাল গণ্য) করব। আর যাকে হারাম পেয়েছি, তাকে হারাম গণ্য করব।”
(খ) কেউ বলতে পারে এই হাদীসে তো মদের কথা আছে। তাহলে মদ যেহেতু হারাম, আর মদকে যেহেতু তারা হালাল গণ্য করছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, মদের বিধানই মদের সাথে উল্লিখিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। উসুলে ফিকহের ভাষায় বলা হয় — দালালাতুল ইকতিরান। অর্থাৎ পাশাপাশি থাকার দলীল। এখন এই হাদীসের শব্দগুলোতে কি দালালাতুল ইকতিরান প্রযোজ্য? প্রযোজ্য হলেও কতটুকু প্রযোজ্য?
এর উত্তর পেতে আমরা হাদীসের শব্দগুলো দেখব।
- প্রথম শব্দ ছিল (হির)। এর অর্থ হচ্ছে যৌনাঙ্গ। তোমার অনুবাদক একে যেনা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু এটা আক্ষরিক/আভিধানিক অর্থ নয়। এখন যৌনাঙ্গ নিয়ে আলাপ করা যাক। হাদীসে বলা হচ্ছে — আমার উম্মতের একদল যৌনাঙ্গকে হালাল গণ্য করবে। এতে কি প্রমাণ হয় যে — সবধরণের যৌনাঙ্গ আমভাবে হারাম? নাকি এটা শর্তযুক্ত? আমরা সবাই জানি — স্ত্রী ও দাসীর সাথে সহবাস হারাম না। সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে — এই হাদীসে শর্তযুক্তভাবে যৌনাঙ্গ হারাম হওয়া বোঝাচ্ছে।
- এরপর আশা যাক (হারির) বা রেশম শব্দ নিয়ে। জানা আছে — নারীদের জন্য রেশম জায়েয। আর পুরুষের জন্য অনুর্ধ্ব চার আঙ্গুল পরিমান রেশম ব্যবহার জায়েয।
সুতরাং অলরেডি প্রমাণ হয়ে গেছে যে, এই হাদীসে শর্তহীনভাবে যৌনাঙ্গ কিংবা রেশম হারাম হবার কোন দলিল নেই। একই কথা মা’আযিফ বা বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রেও কেন প্রযোজ্য হবে না?
(গ) এই হাদিসে তো খোদ বাদ্যযন্ত্রের নিন্দা করা হয় নি, বরং এখানে একটা পরিস্থিতির বিবরণ দেয়া হয়েছে। আমরা ইস্তেহলাল শব্দ নিয়ে কথা বলছিলাম। ফাতহুল বারীতে ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী থেকে ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে, এই হাদিসে ইসতেহলাল অর্থ ইসতেরসাল। ইসতেরসাল অর্থ মজে অতিরিক্ত করা অর্থাৎ মদ, রেশম, যৌনতা ও গানবাদ্যে মজে থাকা। আর এই ব্যাখ্যাটাই হাদীসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কারণ এর মাধ্যমে মদ-গাজা-ড্রাগস ও অবাঁধ যৌনতার হারাম বিনোদনে গানবাদ্যের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আর এটা আমরা সবাই স্বীকার করি যে, নাইট ক্লাবগুলো নেশা, যৌনতা ও মিউজিক ছাড়া জমে না। হাদীসে মূলত এই পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিদের অবস্থাই উল্লেখ করা হয়েছে। এসবে যখন বাড়াবাড়ি করবে মানুষ তখন আল্লাহর আযাব নাযিল হবে, এটাই হাদিসের মূল উদ্দেশ্য।
(ঘ) অর্থাৎ গানবাদ্য যখন নেশা, যৌনতার ন্যায় হারাম কাজের সহায়ক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তখনই এই শর্তযুক্ত পরিস্থিতিতে সেটি নিন্দার আওতায় আসবে। অর্থাৎ গানবাদ্য জায়েয হবে নাকি না, সেটা শর্তসাপেক্ষ আলোচনা। এখন বলতে পারো — “তাহলে মদকেও শর্তযুক্তভাবে হালাল বলেন!” এর জবাবে আমরা বলব — এই হাদীসের বাইরে কুরআনের অকাট্য আয়াত, মুতাওয়াতির সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, মদ শর্তহীনভাবে হারাম। অন্যদিকে রেশম ও যৌনাঙ্গ শর্তযুক্তভাবে জায়েয হওয়া ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। তাই আমরা হাদীসের ‘মুতলাক’ (শর্তহীন) কে মুকাইয়াদ (শর্তযুক্ত) করছি। আবার, মা’আযিফ (বাদ্যযন্ত্র) জায়েয হওয়ার ব্যাপারেও অন্যান্য আয়াত ও হাদীসে দলিল আছে, তাই আমরা একেও শর্তযুক্ত করছি, মুকাইয়্যাদ বানাচ্ছি।
আমাদের এই ব্যাখ্যাই যে সঠিক ব্যাখ্যা তা হাদিসের বাকি অংশ থেকে আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ، يَسْتَحِلُّونَ الحِرَ وَالحَرِيرَ، وَالخَمْرَ وَالمَعَازِفَ، وَلَيَنْزِلَنَّ أَقْوَامٌ إِلَى جَنْبِ عَلَمٍ، يَرُوحُ عَلَيْهِمْ بِسَارِحَةٍ لَهُمْ، يَأْتِيهِمْ — يَعْنِي الفَقِيرَ — لِحَاجَةٍ فَيَقُولُونَ: ارْجِعْ إِلَيْنَا غَدًا، فَيُبَيِّتُهُمُ اللَّهُ، وَيَضَعُ العَلَمَ، وَيَمْسَخُ آخَرِينَ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ “
“আমার উম্মতের মধ্যে একদল লোক যৌনাঙ্গ, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে ইসতেহলাল করবে। আর একদল লোক পাহাড়ের পাশে অবতরণ করবে। তারা ভেড়ার পাল চড়াতে বের হবে, এমনসময় তাদের কাছে কোন প্রয়োজনে পড়ে এক ফকীর আসবে। তারা বলবে — কাল আসো। আল্লাহ তাদের উপর রাতে আযাব পাঠাবেন। তাদের উপর পাহাড় ধ্বসিয়ে দিবেন। অন্যদের আকৃতি বিকৃত করে বানর ও শুয়োর বানিয়ে দিবেন।”
প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে — এই হাদীসে আযাবপ্রাপ্ত লোকদের পরিস্থিতি ও বিশেষণ বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। আর এই বিশেষণগুলো হচ্ছে — তারা শরাব, রেশম, অবাধ যৌনতায় লিপ্ত হবে। সাথে এই বিশেষণও এসেছে যে, তারা বাদ্যবাজনা নিয়ে মশগুল থাকবে। এখন এই বাদ্যবাজনার সাথে তো অশ্লীলতা ও মদ-জুয়া জড়িত থাকার কারণে নিন্দা হতে পারে, যেভাবে যৌনতা ও রেশমের ক্ষেত্রে নিন্দা হবে যখন এটি হালালের সীমানা অতিক্রম করে। অর্থাৎ সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে যে, আল্লাহ এই লোকদেরকে তাদের চরম গাফলতি ও দুনিয়া আসক্তির কারণে আযাব দিবেন।
আমরা যদি এই ব্যাখ্যা গ্রহণ না করি তাহলে হাদীসের শেষের বিষয়টার কী ব্যাখ্যা করবে? ফকিরকে ভিক্ষা দেয়া তো মুস্তাহাব। মুস্তাহাব ত্যাগ করা কি হারাম? তাছাড়া ফকিরকে ভিক্ষা দিবে এমনও তো তারা বলে নি, বলেছে আগামীকাল আসতে। এই হাদীসে উল্লিখিত প্রত্যেকটা বিষয়ই আকার বিকৃতি, পাহাড় ধ্বসের উপযুক্ত গুরুতর পাপকাজ হয়, তাহলে ভিখারিকে ভিক্ষা না দেয়াও তো এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাচ্ছে!
সুতরাং এই হাদীসে যেই দুইটি দলের কথা বলা হয়েছে, তারা উভয়েই দুনিয়াবি আসক্তি, বিলাস-ব্যাসন, খায়েশাত পূজা ও নেককাজে গাফিলতির ব্যাপারে চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাবে। প্রথম দল মদ, নারী, রেশম ও বাদ্যে মেতে থাকবে, দ্বিতীয় দল ভেড়ার পালের মালিক তথা অঢেল সম্পদধারী হওয়া সত্তেও দুস্থ-অভাবীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে গড়িমসি করবে। আর তাদের এই অবস্থার কারণেই আল্লাহর শাস্তি হবে।
অনেকেই বলে কেয়ামতের আগে গানবাদ্য হালাল করা হবে! অথচ দলিল-প্রমাণের আলোকে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি যে সাহাবি ও তাবেয়িদের যুগ থেকেই আলেমদের একদল গানবাদ্যকে হালাল মনে করতেন! এমনকি রাসুলের জীবদ্দশাতেই আনসারি সাহাবিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢোল, বাঁশি, তবলা সহ ফূর্তি করেছেন বলে সহীহ সুত্রে ইমাম তাবারি তার তাফসিরে, ইমাম তাহাবি তার শারহু মুশকিলিল আছারে, ইমামা শাফেয়ি তার মুসনাদে, আবু আওয়ানা তার মুসতাখরাজে উল্লেখ করেছেন। এই নিয়েও আমরা অন্য স্থানে কথা বলেছি।
হাদীস ৩ : এরপর তুমি উল্লেখ করেছ -
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِنَّ اللهَ تَعَالَى حَرَّمَ الْخَمْرَ وَالْمَيْسِرَ والكُوْبَةَ.
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত :
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫০৩; বাংলা মিশকাত ৮ম খণ্ড হা/৪৩০৪)।
উত্তর :
এই হাদীসে তোমার অনুবাদক (কুবা) শব্দের অর্থ করেছেন — সব ধরণের বাদ্যযন্ত্র। এটা অনুবাদকের ভ্রান্তি। কারণ কুবা শব্দটি ইয়েমেনিদের মাঝে প্রচলিত ছিল। এর শব্দের প্রসিদ্ধ অর্থ হচ্ছে — নারদ (লুডু খেলা)। হ্যাঁ, এর অন্য আরেক অর্থও হয় — সেটা হচ্ছে ঢোল (তবল) অথবা বারবাত (ছবি : google بربط )
لإمام أبو عبيد القاسم بن سلام الهروي (ت224هـ) في كتابه غريب الحديث ، فقد قال فيه : «وأما الكوبة : فإن محمد بن كثير أخبرني أن الكوبة النرد في كلام أهل اليمن ، وقال غيره الطبل» . غريب الحديث (4/ 278)
ইমাম আবু উবাইদ আল কাসেম বিন সালাম আল হারাবী (মৃ ২২৪) তার গরীবুল হাদীসে বলেন — “কুবা” সম্পর্কে মুহাম্মাদ বিন কাসীর আমাকে জানিয়েছেন যে, ইয়েমেনিদের আঞ্চলিক ভাষায় “কুবা” অর্থ নারদ খেলা। অন্য মতে — এটি হচ্ছে তবল (ঢোল)।
. وقال ابن الأثير في النهاية في غريب الحديث والأثر : « فيه : “إن الله حرم الخمر والكوبة” : هي النرد . وقيل: الطبل. وقيل: البربط».
ইবনে আসীর “নিহায়াহ ফি গরিবিল হাদিস ওয়াল আছার” এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন — কুবা হচ্ছে নারদ খেলা। এছাড়াও বলা হয় — তবল কিংবা বারবাত।
অর্থাৎ ইমাম আবু উবায়দ ও ইবনে আসির দুইজনই কুবার অর্থ নারদ খেলা হওয়াকেই তারজিহ দিচ্ছেন।
হাদীসে উল্লিখিত কুবা অর্থ যে নারদ খেলা (জুয়ার উদ্দেশ্যে) সেটা স্পষ্ট হয় এ হাদীস থেকে। হাদীসটি বুখারী আল আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন :
সালমান বিন শুমাইর আল-আলহানী সাহাবী ফুযালা বিন ওবায়েদ সম্পর্কে বলেন :
«وكان بجمع من المجامع، فبلغه أن أقواما يلعبون بالكوبة، فقام غضبان ينهى عنها أشد النهي، ثم قال: ألا إن اللاعب بها ليأكل ثمرها، كآكل لحم الخنزير، ومتوضئ بالدم. يعني بالكوبة: النرد»
“সাহাবী ফুযালা বিন ওবায়েদ এক জমায়েতে ছিলেন এমন সময় তার কাছে সংবাদ আসল যে, একদল লোক “কুবা” খেলছে। তিনি রেগে দাড়ীয়ে গেলেন এবং কঠোর ভাষায় একে নিষেধ করে বললেন — যারা এটা খেলবে তারা এর মাধ্যমে (জুয়ায় জেতা) অর্থ যে খায় তার দৃষ্টান্ত তার মত যে শুয়োরের রক্তমাখা মাংস খায়। (রাবী বলেন) কুবা হচ্ছে — নারদ খেলা।”
হাদীস ৪ : আল্লাহর রাসুল ও ইবনে উমারের কানে আঙ্গুল দেয়ার ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা।
عَنْ نَافِعٍ قَالَ سَمِعَ ابْنُ عُمَرَ مِزْمَارًا قَالَ فَوَضَعَ إِصْبَعَيْهِ عَلَى أُذُنَيْهِ وَنَأَى عَنْ الطَّرِيقِ وَقَالَ لِي يَا نَافِعُ هَلْ تَسْمَعُ شَيْئًا قَالَ فَقُلْتُ لاَ قَالَ فَرَفَعَ إِصْبَعَيْهِ مِنْ أُذُنَيْهِ وَقَالَ كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم فَسَمِعَ مِثْلَ هَذَا فَصَنَعَ مِثْلَ هَذَا.
নাফে‘ (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
একদা ইবনু ওমর (রাঃ) বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেলে তিনি তাঁর দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হতে সরে গেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে’ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, আমি একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হতে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম (ছহীহ আবূদাঊদ হা/ ৪৯২৪, সনদ ছহীহ)।
উত্তর :
- এই হাদীস থেকে বরং বাদ্যযন্ত্র জায়েয হওয়া প্রমাণ হয় নিম্নোক্ত কারণে -
১. ইমাম ইবনে হাযম এই হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেন -
ولو كان المزمار حراما سماعه لما أباح عليه السلام لابن عمر سماعه. ولو كان عند ابن عمر حراما سماعه لما أباح لنافع سماعه، ولأمر عليه السلام بكسره، ولكنه لم يفعل وإنما تجنب — عليه السلام — سماعه كتجنبه أكثر المباح من أكثر أمور الدنيا: كتجنبه الأكل متكئا، وأن يبيت عنده دينار أو درهم، وأن يعلق الستر على سهوة في البيت، وبالله تعالى التوفيق.
“যদি বাঁশি হারাম হত তিনি (সাঃ) ইবনে ওমরকে শোনার অনুমতি দিতেন না। ইবনে ওমর যদি বাঁশির আওয়াজ শোনা হারাম মনে করতেন তিনি নাফে’কে শোনার অনুমতি দিতেন না। বরং আল্লাহর রাসুল এই বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলার আদেশ দিতেন। কিন্তু তিনি এমন করেন নি। বরং তিনি নিজে এটা শোনা থেকে বিরত থেকেছেন। এটা তেমনই যেমন তিনি অধিকাংশ দুনিয়াবী জায়েয-মুবাহ বিষয় থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখতেন যেমন — হেলান দিয়ে বসে খাওয়া, ঘরে দিনার-দিরহাম জমা রাখা, ঘরের আঙ্গিনায় পর্দা ঝোলানো ইত্যাদি। আল্লাহু আ’লাম।“
২. আল আবুররি মানাকেবে শাফেয়ী গ্রন্থে বর্ণনা করেন :
أخبرنا محمد بن رمضان المصري، أخبرنا ابن عبد الحكم قال:
((قلت للشافعي: في حديث نافع عن ابن عمر أنه مر بزمارة راع فجعل إصبعه في أذنه، وعدل عن الطريق، وجعل يقول: يا نافع أتسمع؟ حتى قلت: لا.
فقال: هكذا كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يفعل.
فقلت: ينبغي لأن يكون حجة في تحريم السماع. فقال الشافعي: لو كان حراماً ما أباح لنافع ولنهاه أن يسمع، ولكنه على التنزه)) .
“আমাকে মুহাম্মদ বিন রমযান আল মাসরি বলেছেন, তাকে ইবনে আব্দুল হাকাম বলেছেন — আমি শাফেয়ীকে জিজ্ঞেস করলাম — ইবন ওমর থেকে নাফে’ যেই হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে আলোচনা আছে যে তিনি রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ফেলেন এবং পথ থেকে সরে যান। এরপর নাফে’কে জিজ্ঞেস করেন — আওয়াজ শোনা যায়, নাফে? অবশেষে নাফে’ বলেন — না শোনা যায় না। এরপর তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসুলও এমন করেছিলেন। আমি বললাম — এই হাদীস (বাদ্যযন্ত্র) শোনা হারাম হওয়ার প্রমান হওয়া উচিত। শাফেয়ী জবাব দিলেন — যদি এটি হারাম হত, তাহলে তিনি নাফে’কে শোনার অনুমতি দিতেন না। বরং তিনি নিজে এটি থেকে বেচে থাকতে চাইতেন।”
৩. আল্লাহর রাসুল বলেছেন, যদি কোন মুনকার বা নিন্দনীয় কাজ হতে দেখ তবে সেটা হাত দিয়ে বাঁধা দাও, যদি না পার তবে হাত দিয়ে, যদি তাও না পারো তবে অন্তরে ঘৃণা কর। এটাই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। মদিনার পথেঘাটে দেদারসে রাখালরা বাঁশি বাজিয়ে বেড়াচ্ছে, আর আল্লাহর রাসুল সেটা নিজ হাতে প্রতিহত করছেন না, এটা কীভাবে সম্ভব হয়? রাসুল না হাত দিয়ে বাঁধা দিচ্ছেন, না মুখ দিয়ে সেই রাখালকে থামতে বলছেন! রাসুল কি মদিনাতে এতই দূর্বল ছিলেন। গোটা আরব যিনি জয় করে ফেলেছেন, তিনি কি সামান্য একজন রাখালের বাঁশি বাজানো বন্ধ করতে পারলেন না? এ থেকে ইবনে হাযমের ব্যাখ্যাই সঠিক প্রমাণ হল যে, রাসুলের দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি থেকেই বাদ্য শোনা থেকে বিরত থেকেছেন। হারাম হবার কারণে না।
মিউজিক হারাম হবার পক্ষে আরো অনেক হাদিস ও আছার উল্লেখ করা হয়। এদের মধ্যে যেই বর্ণনাগুলো বিশুদ্ধ সেগুলোতে গানবাদ্য হারাম হবার ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন কথা নেই। আর যেগুলোতে সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে সেগুলো একটা বিশুদ্ধ হাদিস না। সেগুলো খণ্ডন করতে গেলে স্বতন্ত্র বই লেখা প্রয়োজন হবে। সংক্ষিপ্ততার জন্য আমরা এই সম্পর্কে কয়েকজন ইমামের বক্তব্য উল্লেখ করে ইতি টানছি।
১। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবি আল মালেকি “আল-আহকাম” এ বলেছেন :
لم يصح في تحريم المعازف شيء .
“বাদ্যযন্ত্রের নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক কোন হাদিসই সহিহ নয়।”
২। ইমাম গাযালী ও ইবনুন নাহবি “আল-উমদা”তে ঠিক একই কথাই বলেছেন।
৩। ইবন তাহির লিখেছেন:
لم يصح من أدلة تحريم المعازف حرفٌ واحد.
বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করে যেসব দলিল দেয়া হয় সেগুলোর একটা অক্ষরও বিশুদ্ধ নয়।
৪। ইবন হাযমের উক্তি,
كل ما رُوي في تحريم المعازف باطلٌ وموضوعٌ
বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করে যত যা বর্ণিত হয়, তার সবগুলোই বাতিল ও বানোয়াট।