ইসলামের স্বর্ণযুগে সঙ্গীতচর্চা — ইসহাক আন-নাদীম ও উলাইয়্যা বিনতে মাহদী।
সিয়ারু আলামিন নুবালা বা মহামনিষীদের জীবনকথন। ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবির রচিত অনবদ্য এক গ্রন্থ। হিজরি অষ্টম শতকের এই ইমাম মুসলিম সভ্যতার কৃতী ব্যক্তিদের জীবনগাথা তিনি এই গ্রন্থে সংক্ষিপ্তভাবে সংকলন করেছেন। আজ এই গ্রন্থ থেকে দুইজনের কথা উল্লেখ করব।
ইমাম যাহাবী লিখেছেন –
إسحاق النديم
الإمام العلامة الحافظ ذو الفنون ، أبو محمد إسحاق بن إبراهيم بن ميمون التميمي الموصلي الأخباري ، صاحب الموسيقى ، والشعر الرائق ، والتصانيف الأدبية مع الفقه واللغة ، وأيام الناس ، والبصر بالحديث ، وعلو المرتبة . ولد سنة بضع وخمسين ومائة .
ইসহাক আন নাদীম
ইমাম। আল্লামা। হাফেয। বহু শাস্ত্রে পারদর্শী। আবু মুহাম্মাদ ইসহাক বিন ইব্রাহিম বিন মায়মুন আত তামিমি। আল মাওসেলি। আল আখবারি (হাদিসবিদ)। মুসিকা (মিউজিক) ও পরিচ্ছন্ন কবিতার অধিকারী। সাহিত্যের পাশাপাশি ফিকহ, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস বিষয়ক বহু গ্রন্থের রচয়িতা। হাদিসে অন্তঃদৃষ্টির অধিকারী। সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী।
তিনি দ্বিতীয় হিজরি শতকের পঞ্চাশের দশকে জন্ম নিয়েছিলেন।
وسمع من : مالك بن أنس ، وهشيم بن بشير ، وسفيان بن عيينة ، وبقية بن الوليد ، وأبي معاوية الضرير ، والأصمعي ، وعدد كثير .
তিনি হাদিস শুনেছেন ইমাম মালেক বিন আনাস, হুশাইম বিন বাশির, সুফিয়ান বিন উয়াইনা, বাকিয়্যা বিন ওয়ালিদ, আবু মুয়াবিয়া আদ-দ্বারির, আসমাঈ ছাড়াও বিরাট সংখ্যক ইমামদের কাছ থেকে।
حدث عنه : ولده حماد الراوية ، وشيخه الأصمعي ، والزبير بن بكار ، وأبو العيناء ، ويزيد بن محمد المهلبي ، وآخرون . ولم يكثر عنه الحفاظ لاشتغاله عنهم بالدولة ، وقيل : ولد سنة خمسين ومائة .
তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তার পুত্র হাম্মাদ আর-রাবিয়া, তার শিক্ষক আসমাঈ, যুবাইর বিন বাক্কার, আবুল আইনা, ইয়াযিদ বিন মুহাম্মদ আল মুহাল্লাবি ছাড়াও অনেকে। তবে রাষ্ট্রীয় কাজে তার ব্যস্ততার কারণে হাফেযরা তার সুত্রে অনেক বেশি হাদিস বর্ণনা করতে পারেন নি। একটি মতে তিনি ১৫০ হিজরিতে জন্ম নেন।
قال إبراهيم الحربي : كان ثقة عالما . وقال الخطيب : كان حلو النادرة ، حسن المعرفة ، جيد الشعر ، مذكورا بالسخاء . صنف كتاب " الأغاني " الذي يرويه عنه ابنه .
ইব্রাহিম আল-হারবি বলেন, তিনি ছিলেন সিকাহ (বিশ্বস্ত) এবং আলেম। খতিবে বাগদাদি বলেন, তিনি ছিলেন বিরল অমায়িক মানুষ। জ্ঞানের শোভামণ্ডিত। সুন্দর কবিতাকার। বদান্যতায় বিখ্যাত। গানবাদ্য বিষয়ে তিনি কিতাবুল আগানি লিখেছেন যা তার পুত্র তার সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
وعن إسحاق الموصلي قال : بقيت دهرا من عمري أغلس كل يوم إلى هشيم أو غيره من المحدثين ، ثم أصير إلى الكسائي ، أو الفراء ، أو ابن غزالة ، فأقرأ عليه جزءا من القرآن ، ثم إلى أبي منصور زلزل فيضاربني [ ص: 120 ] طرقين أو ثلاثة ، ثم آتي عاتكة بنت شهدة ، فآخذ منها صوتا أو صوتين ، ثم آتي الأصمعي ، وأبا عبيدة فأستفيد منهما ، وآتي مجلس الرشيد بالعشي
ইসহাক আল-মাওসেলি বলেন, আমার জীবনের একটা সময় এমনভাবে কেটেছে যে আমি ভোরের আলো ফুটতেই হুশাইম অথবা অন্য কোন মুহাদ্দিসের কাছে চলে যেতাম। হাদিসের দরস শেষে যেতাম আল-কিসাই কিংবা আল-ফাররা অথবা ইবনে আযালার কাছে গিয়ে এক পারা কোরআন পড়তাম। তারপর যেতাম মানসুরের যালযালের কাছে। তিনি আমাকে তারে দুইটি অথবা তিনটি সুর তোলা শেখাতেন। তারপর যেতাম আতিকাহ বিনতে শাহদাহ-র কাছে তিনি আমাকে একটি অথবা দুইটি ছন্দ শেখাতেন। তারপর আসতাম দুই মুহাদ্দিস আসমাঈ ও আবু উবায়দার কাছে, তাদের জ্ঞান থেকে উপকৃত হতাম। এভাবে সন্ধ্যা হয়ে হারুনুর রশিদের মজলিসে হাজির হতাম। (অনুবাদ সমাপ্ত)
উপরের উল্লিখিত নামগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন। ইমাম মালিক বিন আনাস। ফিকহের শ্রেষ্ঠ ইমামদের একজন। ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ, ইমাম আসমাঈ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের দুইজন। আল-কিসাই, আল-ফাররা কিরাআত ও আরবি ভাষাতত্ত্বের শ্রেষ্ঠ ইমামদের দুইজন। এমন মহান ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইসহাক আল-মাওসেলি ইলম শিখেছেন। তার পাশাপাশি সঙ্গীত ও বাদ্য চর্চাও তিনি জারি রেখেছেন। গানবাদ্য সংক্রান্ত ইখতিলাফ যদি গ্রহণযোগ্য ভিন্নমতের আওতাভূক্ত না হত, কী করে ইব্রাহিম আল-হারবির মত মুহাদ্দিসের পক্ষে তাকে সিকাহ বলা সম্ভব হল? মানসুর যালযাল ও আতিকাহ বিনতে শাহদাহর ন্যায় উস্তাযদের কাছে সঙ্গীত ও বাদ্য শেখার পাশাপাশি যুগের শ্রেষ্ঠ ইমামদের দরসে তাকে সমাদর করা হত? আসমাঈ-র মত মুহাদ্দিস তো তার কৃতী এই ছাত্রের সুত্রে হাদিসও বর্ণনা করেছেন!
গানবাদ্য ও সঙ্গীত চর্চা ইসলামি সভ্যতারই অংশ। বর্তমানে সঙ্গীতের কারণে মানুষকে যেভাবে সামাজিকভাবে কলঙ্কিত করা হয় তা মূলত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে তৈরি। মুসলিম ইতিহাসের সূচনালগ্নে তথা সালাফে সালেহিনের যুগে সঙ্গীতচর্চাকে এভাবে বাঁকা চোখে দেখা হত না। কীভাবে মুসলিম বিশ্বে সঙ্গীত হারাম মতটি একপাক্ষিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হল সে সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কায়সারানি আলোচনা করেছেন - https://www.facebook.com/SheikSadiBD/posts/239222351524927 এছাড়াও ফরিদুল ইসলাম ভাইকে দেয়া আমার সাক্ষাতকারেও আমি বিষয়টি উল্লেখ করেছি - https://youtu.be/ZKFNIN5D5A4
হারুনুর রশিদের সময়কার আব্বাসি খেলাফতকে ইসলামের স্বর্ণযুগ আখ্যা দেয়া হয়। আমরা সবাই সেই স্বর্ণযুগের স্বপ্নে বিভোর থাকি। সেই যুগকে ফিরিয়ে আনার কল্পনা রচনা করি। তো সেই স্বর্ণযুগে শিল্প, কলা ও সাহিত্যের প্রতি ইসলামি খিলাফতের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল? ছোট্ট একটি উদাহরণ দেখা যাক।
عُلَيَّةُ بِنْتُ المَهْدِيِّ
وَأُخْتُ الرَّشِيْدِ، الهَاشِمِيَّةُ، العَبَّاسِيَّةُ، أَدِيبَةٌ، شَاعِرَةٌ، عَارِفَةٌ بِالغِنَاءِ وَالمُوْسِيْقَى، رَخِيْمَةُ الصَّوْتِ، ذَاتُ عِفَّةٍ وَتَقْوَىً وَمَنَاقِبَ
উলাইয়্যাহ বিনতে মাহদী।
হারুনুর রশিদের বোন। হাশেমী। আব্বাসী। সাহিত্যিক। কবি। সঙ্গীত ও মুসিকা সম্পর্কে জ্ঞানী। মিহি কণ্ঠস্বরের অধিকারী। সচ্চরিত্র, তাকওয়া ও মর্যাদার অধিকারী।
وكَانَتْ عُلَيَّةُ مِنْ مِلَاحِ زَمَانِهَا، وَأَظْرَفِ بَنَاتِ الخُلَفَاءِ
رَوَى إِبْرَاهِيْمُ بنُ إِسْمَاعِيْلَ الكَاتِبُ: أَنَّهَا كَانَتْ لَا تُغَنِّي إِلَاّ زَمَنَ حَيْضِهَا، فَإِذَا طَهُرَتْ، أَقْبَلَتْ عَلَى التِّلَاوَةِ وَالعِلْمِ، إِلَاّ أَنْ يَدْعُوَهَا الخَلِيْفَةُ، وَلَا تَقْدِرُ تُخَالِفَهُ
وكَانَتْ تَقُوْلُ: لَا غُفِرَ لِي فَاحِشَةٌ ارْتَكَبْتُهَا قَطُّ، وَمَا أَقُوْلُ فِي شِعْرِي إِلَاّ عَبَثاً
উলাইয়্যা ছিলেন তার যুগের অপরূপাদের একজন। খলিফা পরিবারের নারীদের মধ্যে আভিজাত্যে শীর্ষ।
ইব্রাহিম বিন ইসমাইল আল-কাতেব বর্ণনা করেছেন, তিনি ঋতুকালীন সময় সঙ্গীত চর্চা করতেন। শুচি লাভ করলে তিলাওয়াত ও ইলম চর্চায় মশগুল থাকতেন। একমাত্র খলিফা ডাক দিলেই তিনি সাড়া দিতেন, কারণ তার অবাধ্য হতে তিনি সমর্থ ছিলেন না।
তিনি বলতেন, জীবনে যদি কোন অপকর্ম করি তবে কখনোই যেন সেটা ক্ষমা না করা হয়। আমার কবিতায় আমি কেবল নিরীহ কথাই বলি। (অনুবাদ সমাপ্ত)
ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পোস্টে মুসলিম সভ্যতার সমৃদ্ধির সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক সম্পর্কে ইমাম ইবনে খালদুনের তাত্ত্বিক আলোচনা অনুবাদ করার চেষ্টা করব।
Comments
Post a Comment