Skip to main content

সঙ্গীতের জারজিকরণ প্রতিরোধ

 সঙ্গীতের জারজিকরণ প্রতিরোধ

"পিচ্ছিল পাথর" বইয়ের লেখক খেদমাখা কণ্ঠে আক্ষেপ করেছেন, পপ সংস্কৃতি যুবসমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে, সারাদিন তারা পশ্চিমা পপ সংস্কৃতিতে বুঁদ হয়ে থাকে। লেখা পড়ে মনে হল এই পপ সংস্কৃতিটা থেকে যদি তরুণদের মুক্ত করা যেত, তিনি বেশ খুশি হতেন। ভোগবাদী, বস্তুসর্বস্ব, আত্মকেন্দ্রিক, লালসাপূর্ণ পশ্চিমা পপ কালচারের বিকল্প হিসেবে যদি কোন ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি ইয়াং জেনারেশনের জন্য ব্যবস্থা করা যেত, তবে তার কিন্তু আনন্দিত হবার কথা। ভোগের কথা ছেড়ে যেখানে ত্যাগের কথা বলা হবে, বস্তুতে নিজেকে বিলীন না করে বিশ্বের সাথে একাকার হতে আহ্বান করা হবে, আত্মকেন্দ্রিকতা ছেড়ে সমাজ ও মানুষের ভালোর জন্য বাঁচতে মোটিভেট করা হবে - মোদ্দাকথা ইসলামের জগৎ দর্শনকে যে পদ্ধতি ও সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রোমোট করা হবে, এমন একটি বিকল্পের পৃষ্ঠপোষণ করাই ছিল যৌক্তিততার দাবি। অথচ লেখক ইসলামি ভাবধারার মুসলিম সঙ্গীতদলকে পপ সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত করেছেন, দুইয়ের মাঝে কোন তফাত তার পিচ্ছিল দৃষ্টি ধরতে পারে নি। "ইসলামের জন্য কাজ করছে" কথাটা শুনে যেখানে এই শিল্পীদের এখলাস, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠতার প্রশংসা করা উচিত ছিল, সেখানে তিনি উল্টো মজা ও ঠাট্টা করেছেন এবং মস্ত বুদ্ধিজীবী সেজে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আরে, বাদ দাও তোমার ইসলামের নামে কাজ করা! কী পরিমাণ অর্থ ও সময় এর পেছনে ব্যয় হচ্ছে তা খেয়াল করে দেখেছ? অপচয়কারী শয়তানের ভাই ... ইত্যাদি।


এই লেখকদের কে বোঝাবে যে, মুসলিম যুবাদের যদি অর্থ ও সময় অপচয়ের খোঁড়া অজুহাত তুলে ইসলামি ভাবধারার সঙ্গীত চর্চা করতেও নিষেধ করা হয়, উল্টো তাদেরকে ঠাট্টা-মজাকের পাত্রে পরিণত করা হয় তবে এর পরিণতি শুভ হবে না। তারা সেই পপ সংস্কৃতিতে গিয়েই মাথা গুঁজবে। লেখকের যদি এই অনুধাবন ও উপলব্ধি থাকত তবে তিনি হয়ত এ জাতীয় স্বল্পচিন্তিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতেন।

একজন ফকিহ যিনি শরিয়তের সার-নির্যাস উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি এমন বাইনারি চিন্তা লালন করতে পারেন না। অর্থ ও সময় ব্যয় হয় তাই মুসলিম সঙ্গীত দল নিষিদ্ধ করতে হবে - এ রকম কুযুক্তি দিতে পারেন না। ইমাম ইবনে তায়মিয়্যাহ ইকতিদ্বাউস সিরাতিল মুস্তাকিম (২/১২৬-১২৭) গ্রন্থে বলেন,

"কতেক কাজ আছে যা কিছুকিছু মানুষের জন্য শোভনীয়। তবে একজন মজবুত ইমানদারের জন্য সে কাজটি করা দৃষ্টিকটু। এ কারণে ইমাম আহমদকে যখন এক আমিরের ব্যাপারে জানানো হয় যে, সে একটি মুসহাফের পেছনে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা খরচ করেছে, তিনি বলেন: ছাড় তাকে, করতে দাও। তার জন্য এই কাজেই স্বর্ণ খরচ করা সর্বোত্তম। ইমাম আহমদ এই আমিরের ব্যাপারে এমনটি বলেছেন, অথচ স্বয়ং তার মাযহাব মতে কোরআনের সাজসজ্জা করা মাকরুহ। কিন্তু এখানে ইমামের উদ্দেশ্য ছিল যে, তার এ কাজ করার মাঝে এক দিক থেকে কল্যান আছে, যদিও অন্য দিক থেকে চিন্তা করলে একটি মন্দও এখানে আছে - কোরআনকে সাজসজ্জার বস্তুতে পরিণত করা। (ইমাম আহমদের যুক্তি ছিল যে) যদি এই লোকগুলো তাদের অর্থ-সম্পদ এই কাজে ব্যয় না করে তবে মন্দকাজে সেটা ব্যয় করবে, কোন ভাল কাজে করবে না, যেমন - পাপিষ্টদের পাপাচারপূর্ণ রম্যগল্প কিংবা কবিতার বইয়ে নকশা করার কাজে। কিংবা পারস্যবাসীর দার্শনিক বইপত্রে।


সুতরাং ধর্মের এই সারনির্যাসের ব্যাপারে সজাগ সচেতন হও! যে কোন কাজে খুঁজে দেখো যে সেখানে শরয়ি বিচারে ভাল-মন্দ কী পরিমাণে মিশ্রিত আছে। আরো লক্ষ্য কর যে, সেখানে ভালোর পরিমাণটা কতটুকু, আর মন্দের পরিমাণটা কতটুকু। যাতে করে ভাল-মন্দ উভয়ে যখন একত্রিত হবে, তখন যেটা পরিমাণে বেশি তাকে বিবেচনায় রেখে কাজটি করা বা না করার মধ্যে একটিকে প্রাধাণ্য দিতে পারবে।

এই ভাল ও মন্দের স্তরবিন্যাস করা, দলিলের শক্তিমত্তার বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে অবগত হওয়াই মূলত নবি-রাসুলদের নিয়ে আসা জ্ঞানের হাকিকত। দুটি উপায়ের মধ্য থেকে কোনটি বেশি ভাল, যাতে বেশি ভালকে অগ্রাধিকার দেয়া যায়; কোনটি বেশি খারাপ, যাতে বেশি খারাপকে বর্জন করা যায়; আর পক্ষে-বিপক্ষের দলিলের মধ্যে শক্তিশালীটিকে প্রাধাণ্য দেয়া যায় — এই নুয়ান্সড বিশ্লেষণ করতে পারাটাই মূলত এই ধর্মের আলেমদের বিশেষত্ব।" (সমাপ্ত)


আপনি যদি এই ধরণের সুন্দর ও সৃজনশীল কাজ তৈরি করতে না পারেন, ভোক্তাদের জন্য কেবল বাকি থাকবে মিউজিকের নামে কুরুচিপূর্ণতা ও অশ্লীলতার বেসাতি। আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই তরুণদের সংশোধন চান, তবে ঢালাওভাবে মিউজিকের বিরোধিতা না করে মননশীলতার শোভাপূর্ণ ও আধ্যাত্মিকতার স্পর্শধন্য ছন্দ ও দৃশ্য তৈরিতে উৎসাহ দিন। অন্যথায় ফিতরাতি একটি চাহিদাকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে কখনো দমিয়ে রাখতে পারবেন না। কেবল নিষেধ করে যাওয়া হল প্যাসিভিজম। প্যাসিভিজিম কোনদিন কোন সমাধান দিতে পারে নি। সমাধান আসে একটিভিজমের পথে।


ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন :


 والنفوس خلقت لتعمل، لا لتترك، وإنما الترك مقصود لغيره فلا ينهى عن منكر إلا ويؤمر بمعروف يغني عنه 


“নফসকে কিছু ‘করা’র জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, কেবল বিরত থাকার জন্য নয়। বিরত থাকতেও বলা হয় সেই ক্ষেত্রে অন্য কিছু ‘করা’র প্রয়োজীয়তা থেকে। সুতরাং কোন মন্দ কাজে আপত্তি করার সময় অবশ্যই এমন কোন ভাল কাজের সন্ধান দিবে যেন সেই মন্দ কাজটি থেকে অমুখাপেক্ষী থাকা যায়।” (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম)





Comments

Popular posts from this blog

মিউজিকের বিপক্ষে প্রচলিত কিছু হাদীসের জবাব।

নিচের লেখাটি আমার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর সাথে হয়েছিল, তাই “তুমি” সম্বোধন ব্যবহার করেছি। প্রথমে আবু উমামার হাদীস নিয়ে কথা বলা যাক। হাদীস ১: তুমি নিচের হাদিসটি উল্লেখ করেছ। عَنْ أَبِيْ اُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لاَ تَبِيْعُوا الْقَيْنَاتِ وَلاَ تَشْتَرُوْهُنَّ وَلاَ تُعَلِّمُوْهُنَّ وَثَمَنُهُنَّ حَرَامٌ. আবু ওমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় কর না, তাদের ক্রয় কর না, তাদের গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিয়ো না, তাদের উপার্জন হারাম’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৮০)। উত্তর : - এই হাদীস দয়ীফ জিদ্দান (অতি দূর্বল), এমন হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ দেয়া জায়েয নয়। মিশকাতে এই হাদীস উল্লেখ করে গ্রন্থকার বলেন: رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَقَالَ التِّرْمِذِيُّ هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَعلي بن يزِيد الرواي يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ “হাদীসটি আহমদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন। তিরমিযি বলেছেন — এটি গরীর (একক সুত্রে বর্ণিত) হাদীস। আর বর্ণনাকারী আলী বিন ইয়াযীদ হাদীসে ...